আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৬

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব - ১)

লিখেছেন উজান কৌরাগ

ঘর-বাড়ি আর গাছপালা মাথায় সাদা পাগড়ি প’রে স্থির হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে; আলাদা বয়সের দুই-চারজন মানুষ মাথায় সাদা পাগড়ি প’রে হাঁটছে; একটা গাধা আর দুটো রোমশ ভেড়া গায়ে সাদা জামা আর মাথায় সাদা পাগড়ি প’রে সবুজ ঘাস খুঁজছে, কিন্তু ঘাস পাবার উপায় নেই, তাবৎ ঘাস যে মুড়ি দিয়ে আছে সাদা চাদর! আসলে টুপি, জামা কিংবা চাদর নয়; ধবধবে সাদা তুষাররাশি। পাহাড়, পাহাড়ের গাছপালা, পাহাড়ের কোলঘেঁষা ঘরবাড়ি, মানুষ, গাধা আর ভেড়া সকলের ওপরই নিরন্তর বর্ষিত হচ্ছে মিহি দানার সাদা তুষার; আর তুষারাবৃত পথে হাঁটছি আমি, ঠান্ডায় আমার মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, কিন্তু দারুণ উপভোগ করছি আমি এই শুভ্র-শীতল পরিবেশ। পাহাড় বেয়ে, রাশি রাশি তুষার মাড়িয়ে আমি ক্রমশ ওপর দিকে উঠছি; যতো ওপরে উঠছি ততো ঠান্ডা উপভোগ করছি আমি। চারিদিকে সুনসান নীরবতা, উত্তরে হাওয়ায় ভেসে নিঃশব্দ আদরের মতো ঝ’রে পড়ছে তুষার। তারই মধ্যে দ্রিম-দ্রিম শব্দ! প্রথমে দ্রিম-দ্রিম, তারপর দ্রিম-দ্রিমের সাথে পোঁ-পোঁ, আরো পরে যোগ হলো টুং-টাং। আমি ভাবলাম পাহাড়ি কোনো সম্প্রদায়ের বিশেষ কোনো উৎসব, আর সেই উৎসব উপলক্ষে ওরা যেসব বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, এ তারই শব্দ। শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে, এখন আর টুংটাং শব্দটা নেই, শ্রবণেন্দ্রিয়ে শুধু দ্রিম-দ্রিম আর পোঁ-পোঁ শব্দ; অচৈতন্যকাল পেরিয়ে এখন আমার অধচৈতন্যজুড়ে বিস্তীর্ণ তুষারাবৃত জনপদ। কিন্তু জোড়ালো শব্দের দাপটে অধচৈতন্য থেকেও আমার পতন হলো চৈতন্যে। তুষারাবৃত জনপদ থেকে আমি ধপাস ক’রে গড়িয়ে পড়লাম সমতলে; তাও কোনো সবুজ জনপদে নয়, কংক্রিটের আবর্জনাময় এই ঢাকা শহরে; আমি শুয়ে আছি বাঁ-দিকে কাত হয়ে আমার রোজকার বিছানায় কোলবালিশ জড়িয়ে, পর্দার ফাঁক গলে রাস্তার লাইটের সরু একফালি আলো অন্ধকার তাড়িয়ে রেখার মতো পড়েছে আমার পেটের ওপর দিয়ে! কোথায় সেই মিহি দানার শুভ্র-শীতল তুষার, কোথায় তুষারাবৃত ঘরবাড়ি আর কোথায়ই-বা শরীর কাঁপানো উত্তরে শীতল বাতাস! মশারির মধ্যে তীব্র গরমে আমার গায়ের পাতলা গেঞ্জি ভিজে গেছে, মাথার বাঁ-দিকের চুল ভিজে গেছে, গলা-ঘাড়ে প্যাচপেচে ঘাম, কপালে-মুখে ঘাম, ঘামে বালিশ ভিজে চপচপ করছে; অথচ আমি কিনা তীব্র শীত উপভোগ করতে করতে সাদা তুষাররাশির ভেতর দিয়ে হাঁটছি! স্বপ্নের কী ছিরিছাঁদ!

অবশ্য স্বপ্নের আর কী দোষ, দোষ আমার মনের, আমার অদ্ভুতুড়ে কল্পনাশক্তির! অতিরিক্ত গরম পড়লে মশারির কুঠুরির মধ্যে শোবার পর এই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে মনটাকে সরানোর জন্য ঘামতে ঘামতে কল্পনা করতে থাকি যে, আমি আদতেও এই গরম সমতলে নেই, আমি আছি হিমালয়ের পাদদেশের কোনো পাহাড়ি জনপদে, যেখানে অবিরাম তুষার পড়ছে, ঠান্ডা বাতাস হাড় কাঁপাচ্ছে, আর আপনাআপনিই পাওয়া যাচ্ছে মেঘের নিবিড় স্পর্শ! এই অসম্ভব কল্পনা করতে করতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ি আমি, এই তীব্র গরমে আমার ঘুমানোর এ এক মস্ত মহৌষুধ! গ্রীষ্ম কি ভাদ্রের অসহনীয় গরমের দুপুরেও আমি ইউটিউবে বৃষ্টির শব্দ ছেড়ে দিয়ে অনবরত ঘামতে ঘামতে পড়ি কিংবা কাজকর্ম করি আর ভাবি- আহা, কী বৃষ্টি, কী শীতল বৃষ্টি! মাঝে মাঝে গেয়েও উঠি - ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়’! 

যাইহোক, জেগে জেগে অমন অতি কাল্পনিক স্বপ্ন দেখছিলাম বলেই হয়তো ঘুমের মধ্যেও সেই শান্তিময় টুকরো টুকরো ছবিগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল! 

স্বপ্ন অলীক হলেও শব্দটা কিন্তু বাস্তব সত্য, যেন শান্তিময় সমতল কিংবা পাহাড়ি প্রকৃতিতে হঠাৎ আর্বিভূত হওয়া সাইমুম! বালিশে কান পাতলে শব্দটা আরো তীব্রভাবে আঘাত করছে শ্রবণেন্দ্রিয়ে, বীভৎস দ্রিম-দ্রিম আর পোঁ-পোঁ শব্দের সঙ্গে এখন মানুষের চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। শব্দের উৎস এবং উপলক্ষ এখন আমার কাছে পরিষ্কার। ভীষণ বিরক্তিকর আর আপত্তিকর হলেও শান্তিময় ঘুমের মাঝে এই শব্দের সাইমুম বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হয় আমাকে, আমার মতো আরো অনেককে। অন্ধকারে হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সুইচ অন ক’রে দেখলাম আড়াইটা বাজে। গরম আর শব্দের তীব্রতায় বিছানায় উঠে বসলাম। ফ্যানের বাতাস অর্ধেকটাই আটকে দেয় মশারি। মশারি খুলে রাখলে গায়ে বেশ বাতাস লাগে, এমন চটচটে ঘাম হয় না শরীরে। কিন্তু সে উপায় নেই; মা-মেয়ে, খালা-ফুফু, দাদী-নানী, নাতনি ইত্যাদি নিয়ে শরীরে হামলে পড়ে লেডি মশার দল। লেডি না ছাই, মাগির দল! মাগির ঝাড় তোদের ডিম নিষেক, বংশগতি ঠিক রাখার জন্য থ্রিওনিন নামক অ্যামাইনো এসিড দরকার যা স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্তে বিদ্যমান; বেশ ভাল কথা, তা ব’লে তোরা রাতের বেলা জোট পাকিয়ে কামরাতে আসবি, মানুষকে ঘুমোতে দিবিনে! মাগির ঝাড়, তোদের তো সকাল আটটায় ক্লাস ধরতে হয় না, তোরা কি ক’রে বুঝবি, গরমে সারারাত না ঘুমিয়ে সকাল আটটায় ক্লাসে যাওয়ার কষ্ট! ও রাতে গরমে ঘুমোতে পারি না, এ রাতে যাওবা একটু ঘুমাতাম, তারও পোয়া বারো! আজ থেকে শুরু হলো মাঝরাত্তিরে শব্দদূষণ! মশারিটা উচু ক’রে চটজলদি বিছানা থেকে নিচে নামলাম। চটজলদি না নেমে উপায় আছে, মাগির দল পররাষ্ট্রনীতিতে তুখোর, আমেরিকার সম পর্যায়ের, মুহূর্তেই সেঁধিয়ে পড়তে পারে! 

বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। উহ, সাইমুম, সাইমুম! বাপরে বাপ, কী শব্দ! কী বাজায় ওরা? তিনতলার বারান্দা থেকে গলিতে তাকাতেই মূর্তিমান ছয়জন শব্দদৈত্যকে দেখতে পেলাম রাস্তার লাইটের আলোয়; যারা বংশপরম্পরায় মস্তিষ্কের কোষে বহন ক’রে চলেছে সাইমুম, যারা বুকে ধারণ করেছে সাইমুম! ছয়জনের মধ্যে চারজন মুখচেনা; আমাদের সি ব্লকের নয়, ডি ব্লকে কয়েকটা টিনশেড বাড়ি আছে, ওখানেই থাকে ওরা। দু’জনের হাতে দুটো পানির জার, বাঁ-হাতে গলার কাছটায় ধ’রে ডানহাতের চ্যালাকাঠ দিয়ে ধুপধাপ পেটাচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘সেহেরি খাওনের সময় অইচে, উইঠ্যা পড়েন!’ দু’জনের হাতে দুটো ছোট ভুভুজেলা, অনর্গল বাজিয়ে চলেছে। বাকি দু’জনের একজনের হাত খালি, সে শুধু চিৎকার করছে। আর অন্যজনের হাতে একটা সরু লাঠি, সে কেবল লাইটপোস্টের কাছে এসে পরপর কয়েকটা বাড়ি দিচ্ছে; দ্রিম-দ্রিম, পোঁ-পোঁ শব্দের পর এবার টুং-টাং শব্দরহস্যও আমার কাছে পরিষ্কার হলো। ছয়জনের মধ্যে তিনজনের উদোম শরীর, পরনে লুঙ্গি; দু’জনের গায়ে জামা, পরনে হাফপ্যান্ট; একজনের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে হাফপ্যান্ট। ওরা অনর্গল শব্দ আর চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে গলির আরেক মাথার দিকে, তীরের ফলার মতো শব্দ আঘাত হানছে আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে। শব্দের সাইমুমে আমার শ্রবণেন্দ্রিয় আহত, আমি বিরক্ত, ক্ষুব্ধ; আমার দৃষ্টি শরের মতো বিদ্ধ জাগনদার দলের পিঠে, আচমকাই আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো, ‘অসভ্য বর্বরের দল!’

এখন রাত আড়াইটা বাজে, এটা মধ্যযুগ নয় যে এমন বীভৎস শব্দ সৃষ্টি ক’রে মানুষকে সেহেরি খাওয়ার জন্য জাগিয়ে দিতে হবে। প্রত্যেকটা বাড়িতে ঘড়ি-মোবাইল আছে; তাতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখা যায়। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ‘জাগনদার’ শব্দটা বড্ড সেকেলে; জাগনদারের কাজটা ভীষণ বিরক্তিকর আর অভদ্রচিতও। যখন বাড়িতে বাড়িতে ঘড়ি-মোবাইল ছিল না, তখন হয়তো এর প্রয়োজন ছিল। তখন জীবনও আজকের মতো এতো জটিল ছিল না; সকাল পাঁচটা-ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো ক’রে প্রস্তুত হ’য়ে মানুষকে ছুটতে হতো না অফিস কিংবা ক্লাসের উদ্দেশে। 

এই রাত আড়াইটার সময় সবার ঘুম ভাঙানোর কোনো মানে হয় না, কেননা সবাই রোজা থাকে না। অনেক শিশু-বালক রোজা থাকে না, অতিবৃদ্ধ কিংবা অসুস্থও মানুষ রোজা থাকে না, অনেকে এমনিতেই রোজা থাকে না, এছাড়া ভিন্ন ধর্মের কিংবা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষও রোজা থাকে না। অবশ্য ভিন্ন ধর্মের কিংবা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে এদেশের অধিকাংশ সংখ্যাগুরু মুসলমান গণনার মধ্যেই রাখে না; তাদেরকে দয়া-দাক্ষিণ্য আর করুণার পাত্র ভাবে। ভিন্ন মূল্যবোধ সম্পন্ন অথবা আলাদা মতাদর্শী মানুষকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে পীড়ন না ক’রে কিংবা তাদেরকে বিরক্ত না ক’রে কীভাবে একসাথে পাশাপাশি চলতে হয়, তা এদেশের অধিকাংশ সংখ্যাগুরু মুসলমানই জানে না। ভিন্ন মতাদর্শী মানুষ যাতে সংখ্যাগুরুর কোনো আচরণে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, তাদের সংকট কিংবা অসুবিধার জায়গায় দৃষ্টিপাত করা এবং তা সমাধানের চেষ্টা যে সংখ্যাগুরুর-ই করা উচিত, সেই সহবত এদেশের বেশিরভাগ মুসলমানের নেই। এরা পথে-ঘাটে হাঁটে-চলে, অফিস-আদালত করে, খেলাধুলা-শরীরচর্চা করে, শরীয়ত বিরোধী হলেও অনেকে গান-বাজনা করে, সাহিত্যচর্চা করে; কিন্তু অধিকাংশেরই বুকের মধ্যে সর্বক্ষণ থাকে সাইমুম, যা এদের কথাবার্তা, আচার-আচরণের মাধ্যমে ভিন্ন মতাদর্শী মানুষের ওপর প্রায়শই আছড়ে পড়ে। তাতে ভিন্ন মতাদর্শী মানুষের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করলেও বেশিরভাগ মুসলমানই কেউ প্রকাশ্যে কেউবা নীরবে বিপুল আনন্দ অনুভব করে। 

জাগনদার দল আমাদের গলি থেকে অন্য গলিতে প্রবেশ করায় শব্দের দাপট কিছুটা কমেছে। প্রস্রাব চেপেছে আমার, বাথরুমে গিয়ে প্রস্রাব সেরে গায়ের ভেজা গেঞ্জিটা খুলে ফেললাম, ট্যাপ ছেড়ে হাত-মুখ, গলা-ঘাড়-বুক ধুয়ে পুনরায় বারান্দায় গিয়ে গামছা দিয়ে মুছলাম গা-মুখের জল। আর তখনই সচল হলো মসজিদের মাইক-‘আসসালামু আলাইকুম, সম্মানিত রোজাদার ভাই ও বোনেরা, সেহেরী খাওয়ার সময় হয়েছে, সেহেরী খাওয়ার সময় হয়েছে, আপনারা উঠুন, সেহেরী খেয়ে নিন।’ 

সালাম বাদে বাকিটুকু এভাবে আরো দু’বার বলার পর মাইকের কন্ঠরোধ হলো। হাতের গামছাখানা বারান্দার তারে মেলে দিয়ে ঘরে এসে ফ্যানের নিচে দাঁড়ালাম; কী সুন্দর বাতাস লাগছে গায়ে, কিন্তু মাগি মশাদের জন্য এই বাতাসটুকু উপভোগ করার উপায় নেই। এরই মধ্যে পায়ে দু-বার হুল ফুটিয়েছে মাগিরা! পা জ্বলছে, চুলকাচ্ছে। আমার আবার অ্যালার্জির সমস্যা আছে, সে কারণেই কিনা কে জানে মশার কামড়ে খুব চুলকায় আর চুলকালে সে জায়গাটায় চাকা চাকা হ’য়ে যায়। বাইরে থাকলে আরো কামড়াবে, আমি আবার মশারির ভেতর প্রবেশ করলাম। বালিশটা উল্টে দিলাম, মানে ঘামেভেজা পাশটা নিচে দিয়ে মাথা রাখলাম বালিশে। 

দরজার নিচ দিয়ে ডাইনিং-এ আলো দেখতে পাচ্ছি, রান্নাঘরেও শব্দ হচ্ছে; তার মানে মা উঠে সেহেরি বানাতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষণ পরই উঠবে অন্যরা; মানে - বাবা, দাদী আর ছোট আপু। দোতলা থেকে আসবে আমার চাচা, চাচী আর চাচাতো বোন; বাড়িতে থাকলে চাচাতো ভাইও আসতো, কিন্তু সে বাড়িতে নেই, দিন পনের হলো চিল্লায় গেছে। চারতলা থেকে আসবে আমার মেজো ফুফু-ফুফা, ফুফাতো বোন; ফুফাতো ভাইটা আবার কানাডায় থাকে। রোজার প্রথম দিনটায় সবার জন্য সেহেরি এবং ইফতারের বিশেষ আয়োজন আমাদের বাসাতেই করা হয়, এটা আমার বাবার নির্দেশ। অবশ্য সকলের প্রতি নির্দেশ হলেও চাচার প্রতি বাবার অনুরোধ বা আবদার বলাই ভাল। কারণ বয়সে দশ বছরের বড় হলেও বাবা চাচাকে নির্দেশ দিতে পারেন না, বরং চাচাই বাবাকে নির্দেশ দেন। আমাদের বাড়ির সবার সঙ্গে বাবা কঠোর এবং ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ করেন, এমনকি মেজো ফুফাকেও ধমকান; কিন্তু এই বাবাই আবার চাচার সামনে কেমন যেন অপরাধী বালকের মতো আচরণ করেন। সেই হিসেবে বলা যায়, চাচাই আমাদের বাড়ির অভিভাবক, সবাই তাকে মান্য করে, ভয় করে; কেবল আমি ছাড়া। চাচার ভাষায় আমি কুলাঙ্গার নাস্তিক, বংশের কলঙ্ক, বেতমিজ, গুণাগার। থাক সেসব কথা। 

ওই যে মাইকে আবার শুরু হয়েছে - ‘সেহেরীর আর মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি আছে, সেহেরীর আর মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি আছে, আপনারা উঠুন, সেহেরী খেয়ে নিন। সেহেরীর আর মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি আছে, সেহেরীর আর মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি আছে, আপনারা উঠুন, সেহেরী খেয়ে নিন।’ 

এরই মধ্যে আবার আমার গলা ঘেমে গেছে। কী অসহনীয় গরম! এই গরমে ঘুম ভাঙলে আমার আর সহজে ঘুম আসতে চায় না। অনেকে এই ভীষণ গরমেও শোয়া মাত্রই ঘুমাতে পারে, আমি পারি না। আমার বন্ধু জাহিদের কথাই বলি, ওকে বোধহয় আটত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রোদে ফেলে রাখলেও শোয়ামাত্রই ঘুমাতে পারবে; তাবৎ মাগি মশার ঝাড় ওকে ঘিরে কীর্তন করলে কিংবা সাম্বা নাচলেও ওর ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না! আমি ওভাবে ঘুমাতে পারি না, ভাল ঘুমের জন্য একটু আরামদায়ক পরিবেশ দরকার হয় আমার। 

এ বছর চৈত্রমাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে ঢাকাসহ সারাদেশে। তার পর থেকে শুরু হয়েছে খরা। ঢাকা শহর যেন জ্বলছে, বাতাসে আগুনের আঁচ! ঢাকার আকাশের ওপর দিয়ে লোভ দেখাতে দেখাতে মেঘ ভেসে যায় উত্তর-পূর্বদিকে; সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর প্রভৃতি জেলায় প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে; দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতেও প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে; সারাদেশে বজ্রপাতে প্রায় একশো মানুষ মরেছে; বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিবেবে ঘোষণা করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। অথচ ঢাকায় ঝড়-বৃষ্টি তো দূরের কথা, বাতাসে গাছের পাতাটাও যেন নড়ে না! দিনের পর দিন, রাতের পর রাত গরমে সিদ্ধ হচ্ছে মানুষ। আমার চাচীর বড়বোন থাকেন সিলেটে, গতকাল বিকেলেও নাকি তিনি ফোন ক’রে ঝড়-বৃষ্টির শব্দ শুনিয়েছেন চাচীকে, আর বলেছেন, ‘ঢাকা হলো দোজখখানা, গুনাহগারে ভরে গেছে ঢাকা শহর, এই জন্যই আল্লাহ বৃষ্টি দেয় না, গরমে কষ্ট দেয় ঢাকার মানুষরে!’ 

এই কথাগুলো সন্ধ্যায় চাচী আমার মাকে বলছিলেন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে, অর্থাৎ আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, আমিও একজন গুনাহগার এবং এই অনাবৃষ্টির জন্য আমিও দায়ী। 

না, আমার আর সহজে ঘুম আসবে না। ঘুমের রেশ কেটে গেছে। তবে স্বস্তি এই যে, কাল আমার ক্লাস নেই, একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেও কোনো অসুবিধা হবে না। বাবার গলা শুনতে পাচ্ছি ডাইনিং-এ, মাকে কী যেন বলছেন। কয়েক মহূর্ত পরই আমার দরজায় শব্দ হলো।

(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন