আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ৩)

লিখেছেন উজান কৌরাগ


পরিবারের সঙ্গে কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই মতপার্থক্য নয় আমার, মতপার্থক্য আরো অনেক বিষয়ে। বীজগণিতের সূত্রের মতো আমাদের দেশে বিশ্বাসেরও কিছু সূত্র আছে, বিপুল সংখ্যক মানুষের সেইসব সূত্র মুখস্থ-আত্মস্থ; তাদের ধারণা - এটাই নির্ভুল সূত্র এবং একমাত্র এই সূত্রগুলো দিয়েই জীবনের অংকের উত্তর সঠিক হয়, সহি মুসলমান হওয়া যায়; হাজার যুক্তি-প্রমাণ দিয়েও তাদেরকে বোঝানো যায় না যে ওইসব সূত্রের চেয়েও নির্ভুল সূত্র আছে! আমি বাদে আমাদের পরিবারের সকল সদস্যেরই ওই সূত্র মুখস্থ এবং আত্মস্থ। আমাদের পরিবারে নতুন কোনো সদস্যের জন্ম হ’লে ছোট থেকেই বারবার শুনতে শুনতে ওই সূত্রগুলো তাদের মগজে গেঁথে যায়, তারপর আত্মস্থ ক’রে ফেলে। সূত্রগুলো হলো: 

আওয়ামীলীগ+বামপন্থী বিরোধী = বিএনপি+জামায়াত প্রেমী
বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী = জিয়া প্রেমী
সর্বক্ষেত্রে ভারতবিদ্বেষী (গঠনমূলক সমালোচক নয়) = সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানপ্রেমী
বিধর্মী বিদ্বেষী = মুসলমানপ্রেমী

খুব ছোটবেলাতেই ওই সূত্রগুলো আমার মুখস্থ হ’য়ে গিয়েছিল, তারপর আমি নিজে নিজেই আত্মস্থ ক’রে ফেলেছিলাম। জীবনের আঠারোটি বছর আমি ওই সূত্র মেনেই চলেছি। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হ’লে মনে হতো আমার নিজের দেশের বিরুদ্ধে খেলছে ভারত। আমি দু'বার মাঠে বসে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছি। পাকিস্তানের জার্সি-টুপি প’রে, গালে পাকিস্তানের পতাকা এঁকে, গ্যালারীতে ব’সে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছি আর পাকিস্তান-পাকিস্তান ব’লে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে মুখে ফেনা তুলেছি। পাকিস্তানী ক্রিকেটারদেরকে মনে হতো আপনজন, মনে হতো তারা তো আমাদের ভাই। আর ভারতীয় ক্রিকেটারদেরকে মনে হতো আমাদের পরম শত্রু। মনে হতো ওরা কারবালায় আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, এ লড়াই মালাউনদের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর লড়াই! তাই ভাইদেরকে আমরা উৎসাহ দিতাম আর ভারতীয় ক্রিকেটারদের দিতাম গালি। মালাউন, মালু, চাড়াল, হনু, রেন্ডিয়া ইত্যাদি ব’লে গালি দিয়ে ভীষণ আমোদ পেতাম; বাংলাদেশের ভারতীয় সমর্থকদের মনে করতাম ভারতীয় দালাল, তাদেরকে বলতাম, ‘রেন্ডিয়ার দালাল’! বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ হ’লেও বাল্যকালে চাচাকে দেখে পাকিস্তানকেই সমর্থন করতাম। পরের দিকে পড়েছিলাম দোটানায়, শেষ পর্যন্ত দুধভাত সমর্থক হ’য়ে গিয়েছিলাম, মনে হতো, যে জেতে জিতুক; বাংলাদেশ জিতলেও উল্লাস করতাম না, আবার হারলেও মন খারাপ ক’রে ব’সে থাকতাম না! কেবল বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচেই দেশপ্রেম চাগাড় দিয়ে উঠতো, আর ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে তো রক্ত টগবগ ক’রে ফুটতো! তখন স্টেডিয়াম কিংবা টেলিভিশনের সামনে নয়, মনে হতো কারবালায় আছি! 

তখন তো আমি বুঝিনি যে, আমরা পাকিস্তানের পতাকা বাংলার মাটিতে আর ওড়াবো না বলেই আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, ত্রিশ লক্ষ মানুষ তাদের বুকের রক্ত দিয়েছিলেন, দুই লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। আর ভারতীয়রা? পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারাও তো ছিল আমাদের সহযোদ্ধা, সেই দুঃসময়ে এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়ে তারা খাইয়েছে-পরিয়েছে, তাদের সৈন্যরা জীবন দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য। অথচ কী কুৎসিত ভাষায় তাদেরকে আমি গালি দিয়েছি, শত্রু ভেবেছি! এসব করেছি শৈশবে শেখা ভুল সূত্রের ফলে। 

এই সূত্রের কারণেই স্কুল-কলেজে যে অল্প ক’জন হিন্দু সহপাঠী ছিল, তাদেরকে নানাভাবে নানাকথা বলে উত্যক্ত করেছি। ‘মালাউন’ শব্দটিকে সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়ে, ‘মালু’ ব’লে ওদেরকে গালি দিয়েছি হরহামেশা। স্কুলে আমাদের হুজুর স্যার যখন ধর্ম ক্লাস নিতো, তখন হিন্দু সহপাঠীরাও ক্লাসে থাকতো। হুজুর স্যার প্রায়ই হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং ইহুদি ধর্মের সমালোচনা করতো; শুধু সমালোচনা করতো না, কথার ছুরি চালাতো। বিশেষ ক’রে হিন্দুদের দেব-দেবী নিয়ে হুজুর স্যার মজার মজার কথা বললে আমরা খুব আনন্দ পেতাম আর আমাদের হিন্দু সহপাঠী আবির, সুকান্ত, অলক, মহাদেবের দিকে তাকাতাম। হুজুর স্যার বলতো, ‘হেন্দুরা শঙ্খ বাজায় ক্যান, কও তো?’

হুজুর স্যার ‘হিন্দু’ শব্দের উচ্চারণ করতো ‘হেন্দু’। চার হিন্দু সহপাঠী বাদে আমরা সবাই সমস্বরে চিৎকার করতাম, ‘ক্যান স্যার?’

‘মহাদেবের নাম শুনছো তোমরা?’

আমরা আমাদের সহপাঠী মহাদেবের দিকে আঙুল তুলে বলতাম, ‘স্যার, অই যে মহাদেব।’

‘আরে এই মহাদেব না, হেন্দুগো দেবতা মহাদেব,’ ব’লে স্যার দাঁত বের ক’রে হাসতো। 

আমাদের মধ্যে যাদের গ্রামাঞ্চলে যাতায়াত ছিল, হিন্দুদের কিছু কিছু পূজা-পার্বণের সঙ্গে পরিচিত, তারা ‘হ্যাঁ’ বলতাম; আর যাদের গ্রামের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিল না, তারা ‘না’ বলতো।

হুজুর স্যার বলতো, ‘অই যে, হেন্দুরা যে কালীমূর্তি পূজা করে, তার পায়ের নিচে বাঘের ছাল পইরা জটা মাথার যে লোকটা শুইয়া থাকে, তার নাম মহাদেব। মহাদেবের স্বভাব চরিত্র ভাল ছিল না, অসুরদের মা-বোনদের উপর অত্যাচার চালাইতো। একবার সকল অসুুর একত্র হইয়া মহাদেবরে দাবড়ানি দিছিল, দাবড় খাইয়া মহাদেব দৌড়াইতে দৌড়াইতে সমুদ্রে যাইয়া পালাইছিল শঙ্খের ভিতর। অসুররা অনেক খুঁজাখুঁজি কইরাও তারে আর পায় নাই। সে যাত্রায় রক্ষা পাইছিল মহাদেব, আর মহাদেবরে শঙ্খ রক্ষা করছিল বইলাই হেন্দুরা কৃতজ্ঞতাবশত পূজায় শঙ্খ বাজায়।’ 

আমরা এইসব গল্প শুনে হাসতাম আর মহাদেব এবং অন্য হিন্দু সহপাঠীদের দিকে তাকাতাম। ওরা যতো বিপন্ন আর অসহায়বোধ করতো, আমরা ততো আনন্দ পেতাম; আর মহাদেবকে তো ক্ষ্যাপাতামই! তখন বুঝতে পারতাম না যে, এতে ওদের বাল্য-কৈশোরের মনটা ক্ষতবিক্ষত হতো! 

আমাদের সহপাঠী সুকান্ত’র পদবী ছিল গঙ্গোপাধ্যায়। সুকান্ত’র নামের পদবী নিয়ে কৌতুক ক’রে হুজুর স্যার একদিন বলেছিল, ‘তোগো হিন্দগো যে কী নাম; মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়! মানে অইলো গিয়া কেউ মুখ খুইলা পাদ দেয়, কেউ মুখ বন্ধ কইরা পাদ দেয়, কেউ চট কইরা পাদ দেয়, আবার কেউ গন্ধ কইরা পাদ দেয়; হা হা হা...!’

হাসি সংক্রামিত হয়েছিল পুরো ক্লাস জুড়ে। লাল হ’য়ে উঠেছিল সুকান্ত’র মুখ, পুরো ক্লাস সে মাথা নিচু ক’রে ছিল বাষ্পাকুল চোখে। অন্য হিন্দু সহপাঠীদের মুখেও হাসি ছিল না, ওরাও মাথা নিচু করে থাকতো। ওদের ওই নিচু মাথা, বাষ্পাকুল চোখ, থমথমে মুখের অর্থ বোঝার মতো বয়স তখন আমাদের হলেও পারিবারিক শিক্ষা ছিল না ব’লে ব্যথিত হবার বদলে বুনো উল্লাসে ফেটে পড়তাম। 

এরপর থেকে আমরা সুকান্তকে ক্ষ্যাপাতাম, ‘সুকান্ত তুই কিন্তু গন্ধ কইরা পাদ দিবি না, গন্ধ বন্ধ কইরা দিবি!’

সুকান্ত’র বুকের রক্তক্ষরণ আমরা কখনোই টের পেতাম না। হঠাৎ একদিন স্কুলে আসা বন্ধ ক’রে দিল সুকান্ত। পরে আবিরের মুখে শুনেছিলাম, ওরা ভারতে চ’লে গেছে। 

ওই সূত্রগুলো বর্জন ক’রে অন্য সূত্র গ্রহণ ক’রে জীবনের অংক কষা ভীষণ কঠিন, তবে চেষ্টা করলে একেবারে অসম্ভব নয়। ইন্টারমিডিয়েটে আমার একজন শিক্ষক ছিলেন, কবিরুল ইসলাম, আমরা তাকে ‘কবির স্যার’ ব’লে ডাকতাম। বয়সে তরুণ কিন্তু নানা বিষয়ে তার জ্ঞান, ব্যাপক তার পড়াশোনা। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি তিনি আমাদেরকে অন্যান্য বই পড়ার পরামর্শ দিতেন, অনেক বইয়ের নাম বলতেন। কবির স্যার ছিলেন উদার, অসাম্প্রদায়িক এবং সংস্কৃতমনা; ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে অনেক কথা বলতেন। তাঁর বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন এবং ভারতপ্রেম দেখে অন্য অনেকের মতো আড়ালে আমিও তাকে আওয়ামীলীগ এবং ভারতের দালাল বলেছি। কিন্তু অন্যদের মতো স্যারকে আমি পুরোপুরি নাকচ করে দিতে পারিনি তার সততা, স্পষ্টবাদিতা এবং চিন্তার প্রখরতার কারণে। অন্য অনেক স্যারের চরিত্রে অনেক বৈপরীত্য থাকলেও তাঁর কথা এবং কাজে কখনো অমিল দেখিনি, ফলে আমি তাঁকে উপেক্ষা করতে পারিনি। স্যারের কথা মন দিয়ে শুনতাম, তার কথা শুনেই নানা বিষয়ে আগ্রহ জন্মায় এবং সেসব বিষয়ে কিছু কিছু পড়াশোনাও শুরু করি। তারপর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর ঊনিশে পা দিয়ে যখন বিভিন্ন বিষয়ে আরো বেশি বেশি পড়াশোনা শুরু করেছি, ইতিহাসটা জানা এবং বোঝার চেষ্টা করেছি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সন্ধান ক’রে নিজের বোধ দিয়ে তা বিচার-বিশ্লেষণ করেছি, যুক্তির বিপরীত যুক্তিও মন দিয়ে শুনেছি, তখনই একটু একটু ক’রে নিজের ভুলগুলো স্পষ্ট হ’য়ে উঠেছে বোধের আয়নায়। বুঝেছি ভুল পরিবারে জন্ম নিয়ে ভুল শিক্ষায় বড় হয়েছি, এই ভুল শোধরাতে হবে আমাকেই। আঠারো বছরের আমজাদ উসামার ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, সকল প্রকার সংকীর্ণ চিন্তা; সব আমি নিজ হাতে সমাধিস্থ করেছি মানবতার উদার-উর্বর জমিনে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ছাদের নিচ থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়েছি মানবতাবাদের উদার আকাশের নিচে, মুসলিম উম্মাহর সংকীর্ণ শিক্ষার জাল কেটে বেরিয়ে বাইরে এসে নিয়েছি বিশ্ববীক্ষার পাঠ, জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ শিক্ষা জেড়ে ফেলে অনুভব করেছি আমি মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত; হয়ে উঠেছি এক নতুন মানুষ - সবুজ সমতল। 

আমাকে ক্ষমা করুন, কবির স্যার, আপনি যে জ্ঞানসুধা ঢেলেছিলেন আমার কৈশোরের চেতনায়, তাৎক্ষণিক আমি তার রসাস্বাদন করতে পারিনি। আপনার অর্পিত জ্ঞানসুধার বিপরীতে আমি আপনার অলক্ষ্যে আপনার দিকে ছুঁড়েছিলাম পচা কাদা! সঙ্গে সঙ্গে না হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমি ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, কেননা আপনিই আমার ভেতরে এই নতুন মানুষের বীজ বপন করেছিলেন, যে মানুষের শিকড় এখন পৃথিবীতে কিন্তু চেতনার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত অসীম মহাবিশ্বে। কবির স্যার, আপনার মতো শিক্ষকই পারেন সমাজকে বদলে দিতে। 

একটি ধর্মান্ধ পরিবারের বিচরণক্ষেত্র সবুজ সমতলের জন্য ভীষণ রুক্ষ, একটি ধর্মান্ধ দেশে সবুজ সমতলের পথটি ভীষণ অসমতল; তবু পথ চলছি। ধর্মান্ধতার ছাতার নিচ থেকে মানবতার উন্মুক্ত উদার আকাশের নিচে এসে দাঁড়িয়ে গ্রহণ করেছি নতুন চিন্তার নির্যাস, নতুন আদর্শ। এখন আর বুকে বয়ে বেড়াই না সাইমুম, এখন বুকের ভেতর নদী, ঝর্ণা, জল, সমুদ্র, ফুল-ফল, পাখি, ঘাস-লতা, শিশির, মিষ্টি বাতাস, মেঘ এবং আরো কতোকিছুর বসবাস! অতীতের শিক্ষা নিয়ে এখন আর আফসোসও করি না, তবু একটা ব্যাপারে নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না - সুকান্ত’র ভারতে চলে যাওয়া। বছর দুয়েক আগে আবিরের কাছ থেকে জেনেছি, হুজুর স্যার সুকান্ত’র পদবী নিয়ে উপহাস করার পর ও নাকি কাঁদতে কাঁদতে আবিরকে বলেছিল, ‘আমি আর এই দেশেই থাকবো না।’ এর কিছুদিন পরই সুকান্তরা সপরিবারে ভারতে চলে যায়। 

অনেকদিন সুকান্ত’র কথা ভুলে ছিলাম। কিন্তু আবিরের মুখে এই কথা শোনার পর থেকে বারবার সুকান্তকে মনে পড়ে। হুজুর স্যারের ক্লাসে সুকান্ত’র মাথা নিচু ক’রে ব’সে থাকার দৃশ্যটি পাথরের মতো আঘাত করে বুকে। মনে হয় কেবল হুজুর স্যার নয়, আমার কারণেও সুকান্তরা সপরিবারে ওদের পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে চ’লে গেছে, এর জন্য আমিও দায়ী। আজ কেবলই মনে হয়, শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতিত হ’য়ে মানুষকে কেন নিজের দেশ ছেড়ে আরেক যেতে হবে! সুকান্তদের পরিচয় এখন উদ্বাস্তু! অনেক বড় পৃথিবী, যার যখন খুশি যেখানে যাবে, যেখানে ইচ্ছে সেখানে ঘর বেঁধে থাকবে, সেটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ব্যাপার; পাসপোর্ট, ভিসা, কাঁটাতার এসব মানুষকে শোষণ এবং নির্যাতনের হাতিয়ার। আজ যারা ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া থেকে ইউরোপে আশ্রয় নিচ্ছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে, বাংলাদেশ-পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে; এদের অধিকার আছে স্বেচ্ছায় পৃথিবীর যে কোনো ভূখণ্ডে গিয়ে বসবাস করার। কিন্তু জোর ক’রে এদেরকে বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে, নির্যাতন ক’রে এদেরকে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। আর পৃথিবীর এই হাজার হাজার নির্যাতনকারীর অলিখিত তালিকায় একেবারে নিচের দিকে হলেও আমার নামটি আছে; শারীরিকভাবে না হোক, মানসিকভাবে তো আমি সুকান্ত, আবির, অলক, মহাদেবকে নির্যাতন করেছি; এটা ভাবলেই আমি স্থির থাকতে পারি না, দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে! আবির, অলক আর মহাদেব বাংলাদেশেই আছে; আবির জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, অলক রাজশাহী আর মহাদেব খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে; প্রথম বর্ষে ভর্তির কিছুদিন পর অলক আর মহাদেব যখন ঢাকায় এসেছিল, তখন একদিন আমি ওদের তিনজনকে ডেকে ক্ষমা চেয়েছিলাম আমার কৃতকর্মের জন্য। আমাকে ক্ষমা চাইতে দেখে ওরা প্রথমে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হ’য়ে পড়েছিল, তারপর আবির বলেছিল, ‘ক্ষমা চেয়ে কেন আমাদের বিব্রত করছিস, ক্ষমা চাইতে হবে না।’

আমি বলেছিলাম, ‘ক্ষমা আমাকে চাইতেই হবে, বন্ধু, আমি তো জানি যে, আমি তোদেরকে কতো কষ্ট দিয়েছি।’

মহাদেব বলেছিল, ‘জানিস, ছোটবেলা থেকেই আমরা ওসব কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত, এখনো শুনতে হয় - কি ব্যক্তিজীবনে, কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমরা ধরেই নিয়েছি যে, এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে জন্মানোর কারণে আমাদেরকে এইসব প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই যেতে হবে। ছোট থাকতে এসব কথা শুনে কষ্ট পেতাম, এখন এক কান দিয়ে শুনি আরেক কান দিয়ে বের ক’রে দিই। তবু একটা কষ্ট আমাদের বুকে বাজে। আমাদের ব্যথাটা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ কখনোই সেভাবে অনুভব করতে পারে না, তুই যে এতোদিন পর পেরেছিস, এজন্য তোকে ধন্যবাদ।’

আমি মহাদেবের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওর চোখের ভেতর জল টলমল করছে। আবির আর অলকের দিকে তাকিয়েও একই চিত্র দেখতে পেলাম। তিনজনের চোখেই একই রকম জল, মুখে একই রকম অভিব্যক্তি; হয়তো তিনজনের বুকে একই রকম ব্যথা তাই! ওদের চোখের জল আমার চোখেও সংক্রামিত হলো, আমি ওদের তিনজনকে জাপটে ধরলাম।

ওরা তিনজন আমাকে ক্ষমা করেছে, কিন্তু সুকান্ত’র কাছে আমি আজও ক্ষমা চাইতে পারিনি। ফেইসবুকে সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় লিখে কতো বার সার্চ দিলাম, কতো সুকান্ত’র দেখা পেলাম, কিন্তু তাদের মধ্যে আমার বন্ধু সুকান্তকে খুঁজে পেলাম না। তবে আমার বিশ্বাস ওর সঙ্গে আমার দেখা হবেই। যাবার আগে ও আবিরকে বলেছিল যে, ওরা উত্তর চব্বিশপরগণার দত্তপুকুরে চলে যাচ্ছে। আমি একদিন দত্তপুকুরে যাবই সুকান্তকে খুঁজতে, এ আমার আবেগের কথা নয়; আমি যাবই ওর কাছে ক্ষমা চাইতে।

(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন