লিখেছেন শুভজিৎ ভৌমিক
এক দেশে ছিলেন এক রাজা। তার প্রতিদিন নতুন নতুন পোশাক পরার বড় শখ।
একদিন সেই দেশে দু'জন কারিগর আসিল। তাহারা রাজার নিকটে গিয়া বলিল, "আমরা আপনার জন্যে চমৎকার একটি নতুন পোশাক বানাইয়া দিব। তবে সমস্যা হইতেছে, কোনো মূর্খ লোক এই পোশাক দেখিতে পাইবে না।"
রাজা যার-পর-নাই চমৎকৃত হইলেন। "বাহ! তাই নাকি? তবে তো দেখিতে হইতেছে পোশাকটা কেমন! বানাও তোমরা, টাকা যাহা লাগে লাগুক।"
কারিগররা পোশাক বানানো শুরু করিল। দিনের পর দিন ধরিয়া তাহারা পোশাক বানাইয়া যাইতেছে আর রাজ-কোষাগার হইতে টাকা লইয়া আসিতেছে।
রাজা মন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন, "যাও গিয়া দেখিয়া আসো, পোশাক কতদূর বানানো হইল। কিন্তু একটা কথা, কোনো মুর্খ লোক কিন্তু এই পোশাক দেখিতে পাইবে না। হেঃ হেঃ হেঃ। এই সুযোগে জানা যাইবে, তুমি বোকা না বুদ্ধিমান।"
মন্ত্রী গেলেন পোশাক দেখিতে। কারিগরেরা মহা উৎসাহে বাতেনি তাঁত যন্ত্রে তাহাকে পোশাক দেখাইতে লাগিলেন।
কিন্তু হায় ! মন্ত্রী যে কিছুই দেখিতে পাইতেছেন না!
কিন্তু না দেখিতে পাইলে তো প্রমাণিত হয় যে, তিনি বোকা! তবে তো লজ্জার অন্ত থাকিবে না!
অতএব হাওয়ায় অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া তিনি বলিলেন, “আহা! বড়ই সুন্দর পোশাক! অতি চমৎকার! রাজা মশাইকে যা মানাইবে না!” বলিয়া কোনোমতে মান-সম্মান লইয়া তিনি পালাইয়া বাঁচিলেন।
বিকালে মন্ত্রী গিয়ে রাজাকে বলিলেন, "অসাধারণ পোশাক বানানো হইতেছে। হাজারের মধ্যে একটি।"
"বটে!" রাজা যার পর নাই খুশি হইলেন। "তবে যেদিন আমি এই পোশাক প্রথম পরিধান করিব, সেই দিন একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করা হউক।"
অতঃপর কোনো এক শুভদিনে সেই পোশাক তৈয়ার শেষ হইল। কারিগরেরা আসিয়া রাজাকে পোশাক পরাইয়া দিতে লাগিলেন। কিন্তু এ কী! রাজাও যে কোনও পোশাক দেখিতে পাইতেছেন না!
আহারে, দেখিবেন কীভাবে? আদৌ কোনো পোশাক থাকিলে তো!
কারিগরেরা যে প্রতারক, তাহা তো কেহই জানে না ! আসলে কোনো পোশাকই কারিগরেরা বানায় নাই। সবই গায়েবি, সবই ভুয়া।
কিন্তু পোশাক দেখিতে না পাইলে তো প্রমাণিত হয় যে, তিনি বোকা! এখন উপায়?
কারিগরেরা প্রশ্ন করিল, “কেমন হইয়াছে, রাজা মশাই, পোশাক? দেখিতে পাইতেছেন তো?”
“হেঃ হেঃ হেঃ। কী যে বল! দেখিতে পাইব না কেন? আমি কি বোকা নাকি? অসাধারণ, অপূর্ব এ পোশাক।"
গায়েবানা পোশাক পরাইয়া দেয়া হইল রাজাকে। তাহা পরিয়া বিশাল হস্তীর পিঠে চড়িলেন রাজা, রাজকর্মচারীরাও পোশাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
পথের ধারে উৎসুক জনতা রাজার পোশাক শোভাযাত্রা দেখিতেছে। সকলেই বলিতেছে, “আহারে! বাহারে! কতই না সুন্দর পোশাক!” যদিও কেউই কিছু দেখিতে পাইতেছে না, তাই বলিয়া যে তাহারা বোকা, এই কথা তো প্রকাশিত হইতে দেওয়া যাইবে না। অতএব লাগাও তালি।
ভীড়ের মধ্য থেকে এক বালক রাজাকে পর্যবেক্ষণ করিতেছিল। সেও রাজার শরীরে কোনো কাপড়ের অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাইল না। মজা পাইয়া সে চেঁচাইয়া উঠিল, “এ হে, রাজা ন্যাংটা, রাজা ন্যাংটা !”
হুশ হইল রাজার। আসলেই তো তিনি উলঙ্গ !
কোনোমতে লজ্জাস্থান আবৃত করিয়া পলায়ন করিলেন তিনি ।
গল্পের এই অংশটুকু সবারই জানা। কিন্তু পরবর্তীতে কী হইয়াছিল, কেহ কি জানে?
রাজার পাইক-পেয়াদারা সেই বালককে শ্বাসরোধে হত্যা করিয়াছিল। এত বড় সাহস! রাজাকে অপমান করিয়াছিস তুই?
কিন্তু হায়! সর্বনাশ যাহা হইবার তাহা তো হইয়াই গিয়াছে!
যাহাই হউক, দিন বদলাইয়াছে। সেই রাজা আজ নাই। নাই সেই বালক।
আজ তবে এই গল্পের প্রয়োজনীয়তা কী?
হুমম, আসুন, দেখা যাক।
একটি গ্রন্থ অনেক কাল যাবৎ তোলপাড় তুলিয়াছে।
বহু প্রাচীন সেই গ্রন্থ, অন্তত ১৫০০ বছরের পুরানো তো হইবেই। গ্রন্থ যিনি লিখিয়াছেন, তাহাকে কেউ দেখে নাই, কিন্তু গ্রন্থ নিজেই দাবি করিতেছে, ইহা একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা।
গ্রন্থের লেখক গ্রন্থের অভ্যন্তরে নিজের এবং নিজের রচনার গুণাগুণ বর্ণনা করিয়া যেসব তথ্য দিয়াছেন, তাহা থেকে মানুষ জানিল:
১। এটি একটি অতি মহৎ আসমানী গ্রন্থ।
২। ইহার বক্তব্যের অর্থ বাহির করিবার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব আপনার।
৩। কিছু কিছু লোক এই গ্রন্থ বিশ্বাস করিবে না।
৪। তাহারা নরকে নিক্ষেপিত হইবে।
এইসব তথ্য বাদে, মানুষ সেই গ্রন্থের বক্তব্য সম্পর্কে পরিষ্কার হইতে পারিল না।
তবে সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করিয়া নিলো যে, এই গ্রন্থ অতি মহৎ। করিবেই না বা কেন? কেউ কি চায় নরকে নিক্ষেপিত হইতে ?
সহসা পৃথিবীতে কিছু মধ্যসত্ত্বভোগী নায়কের আবির্ভাব ঘটিলো।
তাহারা টিভি চ্যানেলে এই বইটির স্বরচিত তর্জমা করিয়া দিতে লাগিলো। মানুষ দেখিল, “আহা ! কতই না বিজ্ঞ এইসব কোট পরিহিত শীর্ণকায় ভদ্রলোক!”
এক নায়ক ভদ্রলোকের বক্তব্য থেকে জানা গেলো:
এই গ্রন্থ অতিশয় বিজ্ঞানসম্মত। বিজ্ঞান আজ যাহা আবিষ্কার করিতেছে, তাহার সকল বর্ণনা এই গ্রন্থে বহু পূর্বেই দেখানো হইয়াছে, ইত্যাদি।
যাহাই হউক, "মানবতা" নামে এক বালক এতক্ষণ ধরিয়া নায়কের বক্তব্য শুনিতেছিল।
সহসা তাহার মনে প্রশ্ন জাগিলো, “তাহা হইলে বিজ্ঞানের এতসব কিছু আবিষ্কারের পুর্বেই কেন এই গ্রন্থ সেসব কথা বলিয়া দিল না? বিজ্ঞান এইসব আবিষ্কার করা পর্যন্ত অপেক্ষা করিবার কী প্রয়োজন ছিল? তাহাতে করিয়া কি মানব সভ্যতার অগ্রগতি আরও পূর্বেই হইত না?”
নায়ক হাসিয়া কহিলেন, “ইহার উত্তরও এই গ্রন্থে রহিয়াছে। বলা হইয়াছে, তোমরা জ্ঞানের অন্বেষণ কর।"
আর মিথ্যাচার সহ্য করিতে পারিল না মানবতা।
চিৎকার দিয়া উঠিল, “বাহির কর দেখি, এইডস রোগের প্রতিষেধক এই গ্রন্থ কী নির্ধারণ করিয়াছে? এত নীতিবাক্য শুনিবার সময় নাই। এদিকে মানুষের প্রাণ যাইতেছে, আর তোমার গ্রন্থ অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের আশায় মানুষের হাতে আবিষ্কারের দায়ভার দিয়া রাখিয়াছে। কী লাভ তোমার এই মানুষ মারা জ্ঞানের বই দিয়া ?”
নাহ, চরম বিরক্তিকর ! আর তো পারা যায় না। এইবার তবে এই অর্বাচীনকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হউক।
মুখোশ ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিলেন নায়কেরা। সবাই মিলিয়া চাপিয়া ধরিলেন মানবতাকে।
হত্যার বিভৎস আনন্দে গগনবিদারী চিৎকার দিয়া উঠিলেন নায়কেরা।
কেহ কহিলেন, “আল্লাহু আকবর।”
কেহ কহিলেন, “জয় ভগবান।"
চালাইয়া দিলেন ধারাল ছুরি অসহায় বালক মানবতার কন্ঠনালী বরাবর। টপটপ করিয়া রক্ত ঝরিতেছে তাহার গলা বাহিয়া। মারা যাইতেছে মানবতা।
দূরে দাঁড়াইয়া মানবতার মৃত্যুদৃশ্য উপভোগ করিতেছে নায়কেরা। এক হাতে তাদের ধারাল ছুরি। অপর হাতে সেই অতি প্রাচীন আসমানী গ্রন্থ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন