আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১২

সূফীবাদ

লিখেছেন মহসিনা খাতুন 

মানব জাতির ইতিহাস আসলে ধর্মের ইতিহাস – বলেছিলেন ম্যাক্সমুলার। কিন্তু ভারতবর্ষের ঐতিহাসিকদের দেখি ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞান এতটাই সীমিত যে, তাঁদের চিন্তা ভাবনা ইতিহাসকেই দুর্বল করে তোলে । 

আপনাদের মনে হতে পারে , হঠাৎ এই কথা বললাম কেন? আসলে ভারতের ইতিহাসের সেই অংশটা পড়ছিলাম, যেখানে ভারতবর্ষে ইসলামের বিস্তার সম্পর্কিত বিষয় রয়েছে। বর্তমান ভারতে আমরা দেখি, সূফী সন্তদের প্রতি সকলেই শ্রদ্ধায় নত হয়। হিন্দুরা মোটের ওপর মুসলিমদের তেমন পছন্দ না করলেও সূফী সন্তরা কিন্তু হিন্দুদের কাছেও শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু কেন? এই বিষয়টা বোঝার চেষ্টাতেই পড়াশুনা করতে শুরু করেছিলাম। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সূফীদের ভূমিকা কী? কোন জাদুমন্ত্রে তারা এত লোককে ইসলামে আনতে পেরেছিল? উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে অত্যাচারিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সূফীদের সাম্যের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও তাঁদের শ্রদ্ধা করে কেন? 

এই সব বুঝতে গেলে একেবারে শুরু থেকে শুরু করা বাঞ্ছনীয়। প্রথমে আমরা জানব সূফী বলতে ঠিক কাদের বোঝায়? আসলে ‘সূফী’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে অনেকগুলি মত প্রচলিত আছে। যেমন, সূফী শব্দটি সুফ থেকে এসেছে, যার অর্থ হল পশম। অর্থাৎ সেই সময় লোকে রেশম কিম্বা কার্পাস নির্মিত পোশাক পরতো। কিন্তু তপস্যারত একদল সংসারত্যাগী মানুষের দেখা মিলত মদিনায়। তাদের পোশাক হত পশম নির্মিত। যা তারা কৃচ্ছসাধনার জন্য পরতো। এদের সাধারণ মানুষেরা সূফী বলতো। কেউ কেউ মনে করেন যে, সাফ থেকে এই শব্দটির উৎপত্তি। কেননা এরা অন্তরকে সাফ রাখার কথা বলতেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, তাসাউফ বা সত্য-বস্তুর উপলব্ধি থেকে এই সূফী শব্দটির উৎপত্তি। সূফীরা আত্ম-উপলব্ধি ও আল্লাহকে উপলব্ধির মাধ্যমে আল্লাহকে পেতে চান । 

ইসলামী বইগুলোতে বলা হয়, হযরত মুহাম্মদ ছিলেন সর্বপ্রথম সূফী। তার জীবনে ও আচরণে সূফী ভাবের প্রাধান্যই দেখা যেত। তাই তাঁকেই সূফীদের আদিগুরু হিসাবে চিহ্নিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এটা নিতান্তই অপপ্রচার। যে ব্যক্তির সারা জীবন একের পর এক যুদ্ধাভিযানে এবং যৌনসম্ভোগে কেটেছে, এমনকি যে ব্যক্তি তার মৃত্যুর মুহূর্তেও এমন একজন বালিকার বিছানায় ছিলেন, যে তার থেকে বয়সে ৪৫ বছরের ছোট, তাকে সংসারত্যাগী, নির্লোভ, পবিত্রাত্মা সূফীর আখ্যা দেওয়া নিতান্তই হাস্যকর ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া হজরত মোহাম্মদ সূফীদের আদি গুরু হলে ইসলাম আর সূফীবাদ সমার্থক রূপে গণ্য হত। 

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, প্রথম সূফী কে বা কারা? আসলে মোহম্মদের মদিনা জয়ের পরবর্তী সময়ে মদিনায় একদল মানুষকে মদিনায় মসজিদ ই লবভি-র বারান্দায় দেখা যেত, যাঁরা আধ্যাত্মিকতাকে নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করতে চাইতেন, চাইতেন আরবী সমাজ জীবনে আধ্যাত্মিকতার প্রসার। এঁরা মসজিদের বারান্দা ছেড়ে তেমন যেতেন না এবং প্রয়োজন ছাড়া অন্যের সাথে তেমন কথা বলতেন না। সম্ভবত এঁরাই ইতিহাসের প্রথম সূফী দল। তারপর এঁদের হাত ধরেই প্রচারিত হতে থাকে ইসলামী আধ্যাত্মিকতা। তবে তখনো একটি বিশেষ মতবাদ হিসাবে সূফীবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মোহম্মদের মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে হাসান বসরী নামে এক ব্যক্তিকে দেখা যায় প্রথম ইসলামী পঞ্চস্তম্ভকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করতে। এবং তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই তাঁকে ও তাঁর অনুগামীদের লক্ষ্য করে সূফী শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে মানুষদের মধ্যে। এরপর একের পর এক মহান সূফীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে। সুফীবাদের যতই প্রচার ও প্রসার হয়, ততই তার সঙ্গে মিশে যেতে থাকে নতুন নতুন জায়গার সংস্কৃতি। ফলে এদের মধ্যেও বিভিন্ন উপসম্প্রদায় তৈরি হয়। এবং তিনশো বছর অব্যাহত থাকে এই প্রসারের ধারা। ভাবতে পারেন, কেন মাত্র তিনশো বছর বললাম, সুলতানী আমল, মুঘল আমল এমনকি এখনও তো সূফী প্রচার চলছে এই উপমহাদেশে! এই প্রশ্নেরও সমাধান থাকবে এই প্রবন্ধে । 

আসলে প্রথমদিকে সূফীবাদের চরিত্র ছিল অন্যরকম। এই সূফীবাদের উদ্ভব মোহম্মদের মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই। এই সময় সূফীদের শিক্ষা ছিল মোহম্মদের শিক্ষার অর্থাৎ ইসলামের সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু এঁরা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাননি। এর কারণ বিস্তারিত আলোচনা করব,  তবে আপাতত বলে রাখি, এই ধর্মে মান্যতা প্রাপ্ত স্রষ্টা আল্লাহ সূফীদেরও পরিচিত ছিল। এই আল্লাহ-র বিরোধী তাঁরা ছিলেন না। তাই ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ থেকে তারা সরে আসেন নি। কিন্তু মোহাম্মাদকে তাঁরা পছন্দ করতেন না। 

আমরা বর্তমান কালের সূফীদের গ্রন্থগুলিতে দেখি, সূফীদের আদিগুরু মোহাম্মাদ। কিন্তু একথা সর্বৈব মিথ্যা। এটা কেন ও কোন উদ্দেশ্যে করা হয়, তাতে পরে আলোকপাত করব। আগে বলে নিই, সূফী দর্শনের ইতিহাসকে মূলত দু'টি ভাগে ভাগ করে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায় (৯৫০ খ্রী: পর্যন্ত) ও দ্বিতীয় পর্যায় (অদ্যাবধি) । প্রথম পর্যায়ে সূফীরা ইসলামের মধ্যে থেকেই ইসলামের অন্য ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন ইসলামকে বদলাতে এবং মোহম্মদের নবীত্বকে চেয়েছেন খর্ব করতে। এঁদের মধ্যে প্রধান কয়েকজন ব্যক্তির মত উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে: 

১) হাসান আলী বসরি'কে সুফিবাদের জনক বলতে বিতর্কের অবকাশ অতি সামান্যই থাকে। তিনি ইসলামের প্রচলিত রীতি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি সারাদিন সাধন ভজনে ব্যস্ত থাকতেন। এমনকি তিনি নামাজও পড়তেন না সময়ে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলতেনম, “আমি সাধনায় ব্যস্ত। আমার সাধনা নামাজ রোজার থেকেও উত্তম।" 

২) বিখ্যাত সূফী সাধিকা রাবেয়ার নাম অনেকেই শুনে থাকবেন। তিনি প্রথম ইসলামে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সফল হয়েছিলেন, যা আজও চলে আসছে। আর সেটি হল - তিনি আল্লাহকে সীমাহীনভাবে প্রেম করতে বলেছিলেন। কোরআনের শিক্ষা অনুসারে আল্লাহর প্রতি বান্দাদের ভয় মেশানো শ্রদ্ধা থাকা উচিত। যেখানে ভয় থাকে, সেখানে প্রেম থাকতে পারে কি? মহান রাবেয়া প্রায়োগিকভাবেই ইসলামে কোরআনের শিক্ষাকে গৌণ করে তুলেছিলেন। রাবেয়া একবার বলেছিলেন, “আল্লাহর প্রেমে আমার হৃদয় এমন পরিপূর্ণ যে, সেখানে মোহাম্মদের কোনও স্থান নেই।” এঁরা আল্লাহ্‌কে জগত থেকে আলাদা করে ভাবতেন না। এঁরা ভাবতেন, জগতের প্রতিটি বস্তুর সাথে আল্লাহ অন্তরঙ্গ হয়ে আছেন। প্রতিটি বস্তুই তাই আল্লাহরই প্রকাশ। এই মতবাদই সর্বেশ্বরবাদ নামে পরিচিত, যা ইসলামের একেশ্বরবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। 

৩) তাইফুরিয়া শাখার জনক বায়েজিদ বিস্তামী। তাঁর শিক্ষাও ছিল ইসলাম বিরোধী। তিনি সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ত্যাগ করে আল্লাহকে ইবাদত করার কথা বলতেন। নামাজ, রোজা, বিবাহের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনিই প্রথম ফণা ও বক্কা-র কথা বলেন, যা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক আবু আলী সিন্দির কাছ থেকে। The wonder that was India vol.2 -এর রচয়িতা রিজভী মনে করেন, সিন্দি ভারত থেকে গিয়েছিলেন। এই হিন্দু-বৌদ্ধ অতীন্দ্রিয় বাদের জীবন্মুক্তি (নির্বাণ) ও বিদেহ-মুক্তি বিষয়টি তিনি ইসলামে যোগ করেছিলেন বলা যায়। বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা উপার্জন ও অর্থ সঞ্চয়েরও তিনি বিরোধিতা করেছেন। তিনি খুব দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, “আমার পতাকা মোহম্মদের থেকেও বড়।” অর্থাৎ তাঁর অনুগামীর সংখ্যা মোহম্মদের অনুগামীদের চাইতেও অনেক বেশি । 

৪) আবু সাইয়িদ খাজরাজ, যিনি খজরাজি ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন অসামান্য জ্ঞানী ব্যক্তি। তাঁর লেখা ‘কিতাব উস শির’ নামক গ্রন্থ লেখার জন্য তাঁকে মুসলিমরা কাফের অভিধায় অভিহিত করে অত্যাচার করতে ছাড়েননি। তিনি তাঁর বইতে ইসলামবিরোধী অনেক গুপ্ত কথা বলেছিলেন। তিনি বিস্তামীর ফণা ও বক্কা–র ধারণার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। 

৫) সমসাময়িক সূফী আল হাল্লাজ জিক্‌র ও ইবাদতের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে মত্ত হয়ে থাকতেন। তিনি ইসলামের মত অগ্রাহ্য করে বলেছিলেন, উপনিষদের মহাবাক্য ‘আনল হক’ অর্থাৎ (আমিই সত্য বা আমিই ঈশ্বর) [প্রসঙ্গত এই সময়ে ভারতে শঙ্করাচার্য্য এই বাক্যের ই পুনঃপ্রতিষ্ঠায় রত ছিলেন।] এজন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। কারাগারে বসেই হাল্লাজ লিখে ফেললেন তাঁর শয়তান বিষয়ক অবিস্মরণীয় গ্রন্থ “ত সীন অল–অজল” । এখানে একেশ্বরবাদকে তিনি চরম আঘাত করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত টেনেছেন, একেশ্বরবাদ শয়তানের ধর্ম, ইবলিশের একেশ্বরবাদই তাঁকে আদমের প্রতি সিজদা (মাথা নত) করতে দেয়নি, এই একেশ্বরবাদের জন্যই ইবলিশ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল। এই বক্তব্যের ফলস্বরূপ নয় বছর কারাগারে বন্দী থাকার পরও তাঁকে অকথ্য অত্যাচার করে তারপর ফাঁসী দেওয়া হয়। 

৬) সাহলিয়াহ ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা সাহল বিন আবদ-আল্লাহ তস্তরী। তিনি তাঁর নিজস্ব রীতিতে ৭০ দিন পর্যন্ত রোজা রাখতেন। নির্জনে তপস্যার প্রতি জোর দিতেন। 

৭) জুন্নুন মিশরী র মতে সূফীরা আল্লাহর বন্ধু। তাঁরাই আল্লাহর যথার্থ জ্ঞান লাভ করেন। যদিও এর আগের সূফীরা গুরুবাদী ছিল। তবে তত্ত্বের আকারে গুরুবাদ উপস্থাপিত হয়নি। তিনিই প্রথম বলেন যে, গুরুর নির্দেশকে আল্লাহর নির্দেশের সমান গুরুত্ব দিতে হবে। গুরুর নির্দেশের প্রতি এতটা সম্মান আমরা আগে দেখেছি একমাত্র ভারতীয় পরম্পরায়। 

৮) সূফী আবুল হাসান নুরী, যাঁকে সূফী সম্প্রদায়ের চাঁদ বলা হয়, তিনি নিজে সমস্ত কামনা ত্যাগ করেছিলেন। তিনি নামাজ, যাকাত ও রোজা ত্যাগ করেছিলেন। এরপর তিনি মারিফতের জ্ঞান ও শক্তি অর্জন করেছিলেন । 

আরও অনেক ব্যক্তির উল্লেখ করা যায়। কিন্তু অযথা বাহুল্য বর্জন করে কাজের দিকে চোখ ফেরানোই শ্রেয়।

প্রথম পর্যায়ের এইসব সূফীদের মতবাদের সাথে মূল ইসলামের কতটা পার্থক্য, তা বোঝানোর জন্য একটা মোটামুটি পার্থক্য করে দেখান যেতে পারে: 

১) সৃষ্টিবাদী ধর্মগুলির কেন্দ্রে থাকে স্রষ্টা বা ঈশ্বরের ধারণা। প্রথাগত ইসলামের ঈশ্বরতত্ত্বকে একেশ্বরবাদ বলা হয়। কারণ ইসলামে স্রষ্টা একজন সর্বশক্তিমান ব্যক্তিবিশেষ, যাঁর শ্রেষ্ঠ নাম আল্লাহ। তিনি আমাদের জগৎ–বহিঃস্থ। তাঁর গুণ অসংখ্য হলেও তিনি রূপের দিক থেকে জ্যোতিস্বরূপ। কিন্তু সূফীবাদ অনুসারে, আল্লাহ জগৎ বহিঃস্থ নয়, বরং জগতের অন্তঃস্থিত শক্তি বিশেষ। তিনি গুণের দিক থেকে যেমন অসংখ্য গুণের অধিকারী, ঠিক তেমনি রূপের দিক থেকেও অসংখ্য রূপের অধিকারী। 

২) স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কের দিক থেকে বলা যায়, ইসলামী একেশ্বরবাদ অনুসারে আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা। তিনি শূন্য থেকে জগৎকে আপন ইচ্ছা অনুসারে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু সুফিবাদ অনুসারে সৃষ্টি ও স্রষ্টা বলে কিছুই নেই। কেননা কিছুই সৃষ্ট নয়। আল্লাহ এই বৈচিত্র্যময় জগতে নিজেকে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করে চলেছেন। সমস্ত বস্তুই আসলে আল্লাহ। সবই আল্লাহ , আল্লাহই সব। 

৩) মূলধারার ইসলামে আল্লাহ এক অদৃশ্য ব্যক্তিত্ব, যাঁকে কোরআনের ছত্রে ছত্রে ভয় মেশানো শ্রদ্ধা করতে বলা হয়েছে। তা না করলে বা তাঁর নির্দেশ অমান্য করলেই শাস্তির ভয় দেখান হয়েছে। কিন্তু সূফীবাদ আল্লাহকে প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে জিতে নিতে চায়। আল্লাহর সাথে নাচ-গান ও ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেকে ত্যাগ করে আল্লাহকে আপন করে নিয়ে আল্লাহর সাথে মিলিত হতে চায়। 

৪) মূল ধারার ইসলামে নৃত্য-সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের পথভ্রষ্ট মনে করে তাদের জন্য নরকের আগুন বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যদিকে সূফীবাদে নৃত্য-সঙ্গীতকেই আল্লাহর সাথে মিশে যাওয়ার পথ হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। 

৫) মূলধারার ইসলামে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক মালিক-ক্রীতদাসের। এখানে বান্দা বা দাসদের কোনও অধিকার নেই আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার। কিন্তু সূফীবাদ অনুসারে, আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক অংশী ও অংশের সম্পর্ক। মানুষ এবং জগতের সব কিছুই আল্লাহর অংশ। তাঁর অধিকার আছে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার। এবং মানুষের লক্ষ্য এইটাই হওয়া উচিত। 

৬) মূলধারার ইসলাম শুধু ভোগবাদী নৈতিকতায় বিশ্বাসী। এখানে আল্লাহকে পাওয়ার পথ হল, জেহাদের মাধ্যমে রাজ্যজয়। সেখানকার স্ত্রী এবং শিশুদেরকে নিজেদের ভোগসামগ্রী বানানো। অবশ্য হারলেও ক্ষতি নেই, কেননা জেহাদে মৃত্যুবরণ করলে সোজা জান্নাতে স্থান। এবং সেখানে প্রচুর শিশু ও অপূর্ব সুন্দরী নারী বরাদ্দ থাকবে ভোগের জন্য। এখানে পুণ্য কাজ করার উদ্দেশ্যই হল জান্নাতে ভোগের আশা। অন্যদিকে সূফীবাদে জান্নাতকে উদ্দেশ্য করা হয়নি। সেখানে কৃচ্ছসাধন এবং নিষ্কাম,নিষ্কলঙ্ক প্রেমের দ্বারা আল্লাহকে পাওয়ার কথাই বলা হয়েছে। 

আরও অনেক পার্থক্য আছে। তবে বাহুল্য বর্জনের জন্য কেবল মূল পার্থক্য গুলিই দেওয়া হল। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দর্শন তারা পেয়েছিল কথা থেকে? উত্তরে বলা যায় যে, ভারতের সাথে আরবের সম্পর্ক ইসলামের থেকেও অনেক অনেক প্রাচীন। প্রাক ইসলামী আরবের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের হাত ধরেই ভারতে ইসলামের আগমন। প্রাক-ইসলামী আরবের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুধু ভারতেরই ছিল না, ছিল রোম এবং গ্রীসেরও। আর এই তিনটি সভ্যতায় সর্বেশ্বরবাদী মানসিকতা প্রবল ছিল। ফলস্বরূপ প্রাক-ইসলামী আরবে যে প্রতিমা পূজা ও সর্বেশ্বরবাদী চিন্তা প্রবেশ করেছিল এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, সেকথা বলাই বাহুল্য। মনে রাখতে হবে যে, আরব এবং আশপাশের স্থানগুলিতে ইসলামের প্রবেশ কোনও বিবর্তনের মাধ্যমে হয়নি, হয়েছিল বিপ্লবের মাধ্যমে। সেখানকার মানুষদের একটা বড় অংশ বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাই বাধ্য হয়ে তারা বাহ্যিকভাবে যতই ইসলাম গ্রহণ করে থাকুক না কেন, মনে মনে তারা সর্বেশ্বরবাদীই থেকে গিয়েছিল। এমন সময় মুহাম্মদের মৃত্যু হল। আর তারপরেই শুরু হল নবীর উত্তরাধিকার নিয়ে চরম অশান্তি। নতুন ধর্মের এই কুফল সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যায়নি। আর এ থেকেই সূফীদের আবির্ভাব। এই সূফী সন্তরা চেয়েছিলেন ইসলামী জানালাবিহীন সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের মধ্যে আবার সর্বেশ্বরবাদকে পুনঃস্থাপন করতে। তাই বলা যায়, এই মতবাদ মূলত নতুন ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মৃদু বিদ্রোহ, যাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সূফীরা। 

এখন প্রশ্ন হল, এঁরা যদি বিদ্রোহই করবেন ইসলামের বিরুদ্ধে, তাহলে ইসলাম ধর্ম থেকেই বের হয়ে এলেন না কেন? তাঁরা ইসলামের ভেতরেই থেকে গেলেন কেন? 

আসলে এর একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি ইসলামের নির্দেশ কতটা কঠোর ছিল, তা তারা খুব ভালভাবেই জানতো। তারা জানতো যে, ইসলাম থেকে বেরিয়ে আসার অর্থ মৃত্যু। দ্বিতীয়ত, ইসলাম যে-আল্লাহকে স্রষ্টা হিসাবে মানে, সেই আল্লাহর সাথে তাঁদের পরিচিতি ছিল। তাঁরাও আল্লাহ কে মানতেন। কিন্তু তেমনভাবে নয়, যেমনভাবে কোরআনে বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, তাঁদের সকল আপত্তি ছিল মোহম্মদের ওপর। তাই তাঁদের মধ্যে মোহম্মদের বিরোধিতাই প্রাধান্য পেয়েছিল। ইসলামের বিরোধিতা সেভাবে নয়। চতুর্থত, তাঁরা তখনো সংগঠিত ছিলেন না যে, তাঁরা বিদ্রোহ ও জয়লাভ করতে পারেন। এবং সর্বোপরি, সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিমা পূজার পথে ফিরে যেতে পারত না, কেননা তাদের সমস্ত প্রতিমা বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, কেবলমাত্র আল্লাহর কাবাকে ধ্বংস করা হয়নি। তাই তাঁরা ধর্ম ত্যাগ করেননি। সবচেয়ে মজার কথা, এত ধ্বংসলীলার পরেও বাকি সমস্ত মন্দির ধ্বংস করে দেওয়ার পরেও কাবার ধ্বংস না করা বা কাবা ধ্বংস না হওয়াটা সাধারণ মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস কে আরও প্রবল করে তোলে। 

সে যা-ই হোক, তাঁরা যে মতবাদ ব্যক্তিগত বা ক্ষুদ্র দলগত ভাবে শুরু করেছিলেন, তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। হিংসাকে সমর্থন করা মোহম্মদের মতের বিরোধিতা, আল্লাহকে ভয় না করে তাকে আপন করে নিয়ে তার সাথে প্রেমের সম্বন্ধের মাধ্যমে তাকে পাওয়ার কথা বলা, সূফীদের সহজ জীবনযাপন ও তাঁদের মধ্যেকার প্রেম ও সেবার মানসিকতা মানুষকে এই মতের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। এক শতাব্দীতেই সূফী অনুগামীর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়। তারপর তা আরও আরও গতি লাভ করতে থাকে। সূফীরা আরও শক্তিশালী হয়ে মুহাম্মদ বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-বৌদ্ধ তত্ত্বগুলিকে যোগ করতে থাকেন সেখানে। ফলে মানুষ সূফীদের আরও কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। এঁরা শরিয়ত মানতেন না। এঁরা ইসলামের মূল স্তম্ভস্বরূপ নামাজ , যাকাত ও রোজা সম্পর্কিত রীতিনীতি গুলি মানতেন না। নাচ-গান ইসলামে নিষিদ্ধ ছিল, তাঁরা নাচ-গানের মাধ্যমকেই আল্লাহকে পাওয়ার মাধ্যম হিসাবে মনে করতেন। তাঁরা আল্লাহর নামে নাচ -গানে মত্ত হয়ে থাকতেন। এভাবেই তাদের মধ্যে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি জাগত। বায়েজিদ বিস্তামী বলে উঠেছিলেন যে, “আমার মহিমা ব্যাপ্ত হোক। কি মহান আমার গৌরব!” বায়েজিদ আরও বলেছিলেন, “আমার পতাকা মুহাম্মদের থেকেও বড়।” অর্থাৎ  তাঁর সমর্থকের সংখ্যা মোহাম্মদের সমর্থকের থেকেও বেশি। এখানেই বোঝা যায় যে, তাঁরা কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন এই সময় (৮৬০-৮৭৫) । এঁদের প্রকাশভঙ্গী ছিল বাধা-বন্ধনহীন, যা সুক্‌র্‌ নামে খ্যাত হয় ইসলামে। সুন্নিরা ভীত হয়ে উঠেছিলেন। এর ঠিক পরবর্তী সময়ে আল হাল্লাজ অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি থেকে বলে উঠলেন, “আনল হক্‌।” অর্থাৎ আমিই সত্য বা আমিই ঈশ্বর। গোঁড়াপন্থি সুন্নি পরিচালিত রাষ্ট্রশক্তি আতঙ্কিত হয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিল। তখনো যে তিনি থামেননি। তিনি একেশ্বরবাদকে ভ্রান্ত, দুষ্ট এবং শয়তানের ধর্ম বলে প্রচার করেছিলেন, গ্রন্থ লিখেছিলেন। আর সেই কারণে তাঁর কী পরিণতি হয়েছিল, তা আগেই আমরা জেনেছি। খালি হাল্লাজ নয়, অনেক সূফীকেই সেই সময়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের থামান যায়নি, বরং তাঁদের সাহস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। 

প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভাল যে, সেই সময় অর্থোডক্স ইসলামের বিরুদ্ধে শুধু সূফীরাই বিদ্রোহ করেননি, মুতাজিলা নামক একটি দার্শনিক সম্প্রদায় ইসলামের মূল বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে চলেছিল। এ মতের আবির্ভাব যেন সূফীদের সাহায্যার্থেই। প্রথম সূফী বসরীর শিষ্য ছিলেন ওয়াসীল বিন আতা (মৃত্যু ৭৪৮ খ্রীঃ), যাঁকে মুতাজিলা মতের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। মুতাজিলারা আক্রমণ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ইসলামী সমাজকে, যা মোটেই তাচ্ছিল্য করা যায়নি। কেননা মুতাজিলারা সংখ্যায় কম হলেও ইসলামী দর্শনের মূলে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছিল। এরা ছিল প্রবল যুক্তিবাদী। এক কথায় বলে যায়, মুতাজিলারা ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে আঘাত করেছিল, সমাজ জীবনে আঘাত হেনেছিল সূফীরা। এই দুই-তরফে দুটি পৃথক আক্রমণ অর্থোডক্স (সুন্নি) ইসলামে ভাঙ্গন ধরিয়েছিল। সুন্নিরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল দুটি শাখায়। হানাফি ও মালেকী। এই সময় আবির্ভাব ইমাম শাফেয়ীর (৭৬৭-৮২০ খ্রীঃ) । তিনি এই দুটি মতবাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে তাকে আরও অর্থোডক্স করে তুলতে চাইছিলেন। কিংবা বলা যায়, আরও মূলের দিকে নিয়ে যেতে চাইলেন। এই শাফেয়ী ঘরানার দর্শনের ধরনটাই এমন যে, এই দর্শনের অনুগামীরা আস্তে আস্তে আরও গোঁড়া হয়ে পড়বে। হয়েছিলও তাই। এই ঘরানা থেকে বেরিয়ে এল ইমাম হাম্বল (৭৮৬-৮৫৫) । তার মত ইসলামের সবচেয়ে গোঁড়া মত হিসাবে খ্যাত। মূল আরবে এখনও হাম্বলি ঘরানার প্রাধান্য লক্ষণীয়। এই ঘরানা প্রসব করেছিল আরও এক ভয়ঙ্কর দানবকে, যে ইসলামের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। ইমাম গাজ্জালী (১০৮০-১১১১ খ্রীঃ) । এই প্রসঙ্গে পরে আসছি । 

যাই হোক, সেই সময় মুতাজিলাদের ধ্বংস করেছিল আল আশারী (৮৭৩-৯৩৫) । তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি। মুতাজিলাদের যুক্তি-পদ্ধতি ও হাম্বলি সিদ্ধান্তকে হাতিয়ার করে তিনি এবং তাঁর মুষ্টিমেয় কিছু (হাম্বলি) অনুগামী মুতাজিলাদের তীব্র সমালোচনা শুরু করলেন এবং রাজানুগ্রহ লাভ করে ফুলে ফেঁপে উঠলেন। রুদ্ধ হল ইসলামের অগ্রগতির দ্বার। হাম্বলিদের সাথে যৌথভাবে তিনি ধ্বংস করেছিলেন মুতাজিলাদের। পরবর্তীকালে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেই হাম্বলিরা যুক্তিবাদকে ইসলামের ধারে কাছে আস্তে দেয় নি। 

কিন্তু এই পদ্ধতি সূফীদের থামাতে পারছিল না। কেননা, সূফীদের মূল শক্তি ছিল তাদের সঙ্গীত। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান যে-শ্রেণীর মানুষদের কাছে পৌছতে পারে না, তাদের কাছে শুধু নয়, খুব সহজেই তাদের হৃদয়ের মর্মস্থলে পৌঁছে যায় সঙ্গীত। একে আটকানো এতটা সহজ নয়। এ অনুভূতির বস্তু। একে যুক্তি দিয়ে রোধ করার চেষ্টা করলে ব্যর্থ হতেই হবে। 

ইসলামপন্থীরা বুঝলেন যে, এক-আধজনকে হত্যা করে লাভ কিছুই হবে না। যেভাবে সূফীরা দিন দিন বাড়ছে, তাতে ইসলামের আকাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে বাধ্য। তাছাড়া তারা আস্তে আস্তে এত সংগঠিত হয়ে উঠছে যে, তাদের উপেক্ষা করা যায় না, তারা যেহেতু ইসলামের বাইরে যায়নি, রাজনৈতিক ক্ষমতাও দাবী করেনি কখনো, তাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও মুশকিল। তাহলে এখন কী উপায়? 

ইসলামের ইতিহাস মূলত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, বিশ্বাসঘাতকতা আর অন্তর্ঘাতের ইতিহাস। তাই তারা খুব সহজ উপায় গ্রহণ করেছিল। আর তা হল অনুপ্রবেশ ও অন্তর্ঘাতের ষড়যন্ত্র। গোঁড়াপন্থিদের অনেককে অনুপ্রবিষ্ট করা হয়েছিল সূফী সন্তদের শিষ্য করে। এবং এর ফলশ্রুতি – একশ বছরের মধ্যেই লক্ষ্য করা গেল, সূফীরা বিভিন্ন দল ও উপদলে ভাগ হয়ে গেল। 

ইতিহাসে এই সময়টাকে (৯০০ – ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) সূফী মতবাদের দ্রুত বিকাশের সময় হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। খালি উপদল ও গোষ্ঠীতে বিভাজনই নয়, বরং প্রতিটি শাখা নিজেদের মত এবং পথের কথা নিয়ে অনেক অনেক গ্রন্থ রচনা করতে থাকে। ছড়িয়ে পড়তে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু আসলে এই সময়টা বলা যায়, নিভে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো জ্বলে ওঠার সময়। প্রকৃতপক্ষে এটা দ্রুত বিভাজন, মতানৈক্য এবং দুর্বল হয়ে যাওয়ার সূচক। তাছাড়া এই সময়ে মুতাজিলাদের পতন ঘটায় সূফীরা একটা বড় সমর্থন হারায়। 

এই সময়কার সূফীদের দু'টি ভাগে ভাগ করা হয়, “সুক্‌র্‌” - যাঁদের বক্তব্য ছিল অবাধ ও নির্ভয়। আর “শ” - যাঁরা খুব সংযতভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করতেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা আদি পর্যায়ের সূফীদের বিরুদ্ধমত পোষণ করতেন, যদিও বাহ্যিক আচরণে সূফী সাজতেন।

এই সময় (৯৫০ খ্রীঃ নাগাদ) হঠাৎ অদ্ভুতভাবে একটি অতি সন্দেহজনক সূফী শাখার আবির্ভাব ঘটে, খফিকী শাখা। এই শাখার মতাদর্শে আশারিয় দর্শনের প্রভাব প্রবল। সূফীদের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কাশফ-উল- মাহজুব’ নামক গ্রন্থে লেখক হযরত দাতা গঞ্জ বক্‌শ্‌ এই শাখার কথা উল্লেখ করেছেন, যাদের গুরুশিষ্যের তালিকা পাওয়া যায় না। এদের মতবাদ তিনি তাঁর গ্রন্থে সংযুক্ত করলেও কেন এদের সঠিক বিবরণ লেখেননি, বা তথ্যহীনতা সত্ত্বেও লেখক কেন এই শাখাকে সন্দেহ করেননি, তা নিয়ে যথাসময়ে আলোচনা করা হবে। এই সূফীরা অন্যান্য সূফীদের মতো জীবনাচরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং শরিয়তী সমস্ত নিয়ম মানতেন। নামাজ রোজা ও যাকাত নিয়ে এ যাবতকাল পর্যন্ত সূফীদের পরনে থাকতো চটের পোশাক, যা আগে কোনও সূফী ব্যাবহার করেননি। আর একটি বিষয়ে অন্যান্য সূফীদের সাথে তাদের মতপার্থক্য ছিল। সেটা হল: তাঁরা নিজেদেরকে আল্লাহর বন্ধু না বলে আল্লাহর দাস বলে ভাবতেন। সহজেই এই সিদ্ধান্ত করা চলে যে, সূফীদের ইতিহাসে এটি একটি বিশ্বাসঘাতক শাখা, এবং এরা একা ছিল না। আরও কয়েকটি শাখা নিশ্চয়ই ছিল, যাদের কথা জানা যায় না। তবে তারা সকলেই “শ” ছিল।

এভাবে সূফী আন্দোলন দুর্বলতর হতে শুরু করলো। সাধারণ লোকের সূফীদের প্রতি বিশ্বাস কমে যেতে শুরু করলো। এই সময়ে আবির্ভুত হলেন হযরত দাতা গঞ্জ বক্স ও আল গাজ্জালি। মহান সূফী হিসাবে খ্যাত দাতা গঞ্জ বক্স “কাসফ উল মাহজাব” গ্রন্থ লেখেন, যা বর্তমানে সূফীদের মধ্যে সর্বাগ্রে স্থান পায়, তাতে সূফীদের নিন্দা করা হল এবং শরিয়ত মেনে চলার আদেশ দেওয়া হল। এর পর আবির্ভাব হয় মহাদানব আল গাজ্জালি-র। তিনি প্রথম জীবনে শাফেয়ী সুন্নি ছিলেন। তিনি মূলধারার ইসলামের পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। আশারিয় মত ও যুক্তিপদ্ধতি সম্পর্কে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ পেয়েছিলেন। রাজানুগ্রহে দিন তাঁর ভালই কাটছিল, আচমকা কোনও এক অজ্ঞাত কারনে তিনি সূফী মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি যে উচ্চাভিলাষী ছিলেন, সে কথা স্যর সৈয়দ আমির আলি তার দি স্পিরিট অফ ইসলাম গ্রন্থে স্বীকার করে নিয়েছেন। রাজ নির্দেশে তিনি এ কাজ করেছিলেন কি না, জানা যায় না, তবে ইঙ্গিত একটা পাওয়া যায়। তিনি নিজেকে সর্বদাই শাফেয়ী মাযহাবের বলে দাবী করতেন। কখনই সূফী বলতেন না। “ইবনে খাল্লিকান যথার্থই বলেন যে আল গাজ্জালি শাফেয়ী মতবাদের পণ্ডিত ছিলেন। “জীবনের শেষ দিকে শাফেয়ী মাযহাবের ভেতর তার সাথে তুলনা করার মতো কেউ ছিল না।” - দি স্পিরিট অফ ইসলাম, স্যার আমির আলী। তিনি সেইসময়কার সূফীদের সাক্ষাত পেয়েছিলেন খানকায়, অর্থাৎ পৌত্তলিকদের মতো মঠ বা আশ্রমে। তারপর তিনি সূফী ও মুতাজিলাদের মতের বিরুদ্ধে একটি বই লিখলেন, “তহাফুত উল ফালসিফা” অর্থাৎ দার্শনিকদের বিনাশ। সেখানে তিনি সূফীদের “বেশারা” বা নিয়ম বহির্ভুত বলে ফতওা দিলেন। গোঁড়া ইসলামী মতকে সমর্থন করে বললেন মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। একের পর এক গ্রন্থ লিখে তিনি সূফী মতবাদের উপর আঘাতের পর আঘাত করে চললেন। বন্ধ করে দিলেন ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করার সকল পথ। ফলে সূফীদের বিরুদ্ধে গোঁড়া ইসলামের বিজয় হয়। “বিকাশশীল সমাজের ভিত নড়ে যায় এবং প্রগতিবাদের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়” - ইসলামের ইতিহাস, সৈয়দ আব্দুল হালিম। এসব সত্ত্বেও তিনি কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে মোহম্মদের পর আবির্ভূত জ্ঞানী হিসাবে অভিহিত হন। তার প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে, ঐতিহাসিক ফিলিপ কে হিটটি ও মনে করেছেন যে, আশারি ও গাজ্জালির জন্যই ইসলামী বিশ্ব এখনো নিশ্চল অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি তাঁর সারা জীবনে ৭০-এর থেকেও বেশি গ্রন্থ লিখে সূফী মতবাদকে গোঁড়াপন্থি ইসলামী মতে রূপান্তরিত করেন। এই সময় থেকে আস্তে আস্তে সূফীবাদ ইসলামের বিরুদ্ধ পথ থেকে সরে গিয়ে ইসলাম প্রচারের মেশিনে পরিণত হয় । 

সে যাই হোক, সূফীরা তাঁদের মতবাদ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন দেশে দেশে। এবং নিজে নিজের মত প্রচার করতে লাগলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে ভারতবর্ষেও আসেন। তবে ভারতবর্ষে যাঁরা মতপ্রচার তাঁরা প্রত্যেকেই শ সম্প্রদায়ভুক্ত। এরা সুফিবাদ প্রচার করতে আসেননি। এসেছিলেন ইসলাম এর প্রচার করতে। কারণ, ভারত হল ইসলামের আদি পিতা আদম এর জন্মস্থান। আর সেখানেই মূর্তিপূজা সর্বাধিক প্রচলিত। এখানকার ভূমি পুন্যভূমি। এখানকার মানুষ জ্ঞানী। তাই ইসলামকে পৌত্তলিকতা মুক্ত রাখতে গেলে ভারতবর্ষকে দখল না করে তা করা যাবে না। ভারতে আগমনকারী সূফীদের প্রধান সম্প্রদায়গুলি আমরা দেখে নেব। এবং এরই মধ্যে আমরা বিচার করে দেখে নেব যে, এদের মধ্যে আদি পর্যায়ের সূফীদের বৈশিষ্ট্য ছিল কি না। 

প্রশ্ন হতে পারে  এখানে কি সুক্‌র্‌ সূফী একজনও আসেননি নিজ মত প্রচারে? হয়ত এসেছিলেন। কিন্তু ইসলামী শাসকদের অনুগ্রহ তাঁরা পাননি বলেই তারা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যান। বাকিরা ইসলামী শাসকদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন ভারতকে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। 

ভারতে যে কয়টি সূফী সম্প্রদায় এসে নিজ নিজ মতের প্রচার চালায়, তারা ঠিক কতটা নিজ মতের প্রচার চালায় তা আমরা পরে আলোচনা করব। ভারতে প্রচারকারী মোট আটটি সম্প্রদায়ের কথা সবিস্তার জানা যায়। এদের মধ্যে চারটি খুব বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সেগুলি হল: 

১) চিসতী শাখা: ভারতবর্ষে এই শাখা সর্ব প্রথম আসে আনুমানিক ১১৯০ খ্রিষ্টাব্দে খ্বাজা মইনুদ্দিন চিশতীর হাত ধরে। এই শাখার সবচেয়ে বিখ্যাত দুইজন সূফী হলেন তিনি নিজে এবং নিজামুদ্দিন আউলিয়া। খ্বাজা মইনুদ্দিন চিশতী হিন্দু ধর্মকে গভীর ঘৃণা করতেন। আজমীর এসে তিনি অনেকগুলি দেবমন্দির দেখতে পান। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ওগুলি ধ্বংস করার অঙ্গীকার করেন। তাঁর রীতিমত সেনাদল ছিল। তিনি প্রতিদিন একটি বিখ্যাত মন্দিরের সামনে হিন্দুদের পবিত্র মনে করা গরু জবাই করতেন ও এবং তার কাবাব বানিয়ে খেতেন। এটি তিনি করতেন শুধুমাত্র হিন্দুদের প্রতি গভীর ঘৃণা প্রদর্শনের জন্য। তিনি হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র দুটি হ্রদ আনাসাগর ও পান্সেলা শুকিয়ে দিয়েছিলেন চক্রান্ত করে। দয়ালু হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান এতবার মোহম্মদ ঘরিকে ক্ষমা করে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে ঘরীর বিশ্বাসঘাতী যুদ্ধে তিনি ঘরীর সাথে হাত মিলিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাজিত হলে তিনি তার জেহাদী উদ্দীপনায় এই বিজয়ের গৌরব নিজের কাঁধে নিয়ে বলেন, “আমরা পৃথ্বীরাজ কে জীবন্ত আটক করে ইসলামের বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিলাম” । নিজামুদ্দিন আউলিয়াও মইনুদ্দিনের পথেই হেঁটেছিলেন। তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে একাধিক সুলতানের অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিয়মিত হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। সুলতান আলাউদ্দিনের জিহাদে তাঁর সঙ্গ দেওয়ার জন্য প্রাপ্য গনিমতের প্রচুর উপহার তিনি গ্রহণ করতেন এবং গর্ব ভরে দেখাতেন সকলকে। তিনি বাংলার সিলেটের রাজা গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে জেহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য বাংলার শ্রেষ্ঠ সূফী শাহজালালকে ৩৬০ জন ভক্তসেনা সহ প্রেরণ করেন। তাঁরা পেছন থেকে হানাদারী কারমন চালিয়ে গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করে। সঙ্গে সঙ্গে চলে কয়েক হাজার হিন্দু নাগরিক হত্যা ও বাকিদের তলোয়ারের ডগায় ধর্মান্তরণ। নিজামুদ্দিনের শিষ্য আমির খসরু সর্বদাই তাঁর কবিতায় হিন্দুদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। খিজির খাঁ চিতর বিজয়ের পর যে তিরিশ হাজার হিন্দুর শিরোশ্ছেদ করেছিলেন, তার জন্য তিনি আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ দিয়েছেন। মালিক কাফুর যখন দক্ষিণ ভারতের কেতি মন্দির ধ্বংস করে সেখানকার ব্রাহ্মণদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন, তখন তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখেছিলেন, “মোহম্মদের ধর্মের বিজয়ের জন্য আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ। কোনও সন্দেহ নেই, যে পাথরকে গাওয়াররা পুজ করে, তা তাদের কোনও কাজে আসে নি, তারা পরপারে গেল শুধু পূজার অর্থহীনতার সাক্ষ্য বহন করে” । এরকম অনেক নৃশংসতার তিনি আনন্দের সাথে কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন, অনুশোচনার নামগন্ধ কখনই তাঁর কাব্যে প্রকাশ হয়নি। 

২) সুহরাওয়ার্দী: এই শাখা এসেছিল একাদশ শতকের মধ্যভাগে। তবে এই শাখার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ইসলামী পণ্ডিত শেখ মোবারক গজ্‌নবি। তিনি অমুসলিমদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা প্রকাশ করতেন। তিনি বলতেন, “হিন্দু ও বৌদ্ধদের নাস্তিকতা ও মূর্তিপূজা উচ্ছেদ না করলে আল্লাহ্‌ ও নবীর বিরুদ্ধাচার করা হবে। ওদের সংখ্যাধিক্যের কারণে যদি সম্পূর্ণ বিলোপ না-ও করা যায়, তাহলে তাদের প্রতিনিয়ত অসম্মান ও অমর্যাদা করতে হবে। এরা আল্লাহ্‌ ও নবীর নিকৃষ্টতম শত্রু।” 

এই শাখার এক সূফী দিল্লীর শেখ রুকন্‌-উদ্‌-দিন তুলনামুলক ভাবে অনেক উদার ছিলেন। উগ্র মুসলিম শাসক ফিরজ শাহ তুঘলক তার আত্মিজবনীতে বলেছেন যে, “রুকন্‌-উদ্দিন নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি মেহদী বলে ঘোষণা করেছিলেন (সুন্নি মতবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে), তাই তিনি তাকে বন্দী করেন” । পরে জনগণ তাঁকে ও তাঁর ভক্তদের হত্যা করে এই শাসকের উস্কানিতে তাঁকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ও তাঁর হাড় গুলোকে খণ্ড খণ্ড করে দেয়। এ থেকেই বোঝা যায় শাসকদের সহায়তা ছাড়া ভারতে সূফীদের মত প্রচারের কোনও অধিকারই ছিল না। 

এরপর দিল্লীতে এই শাখায় সৈয়দ জালালুদ্দিন বুখারী নামক এক সূফীর আবির্ভাব ঘটে, তিনি মকদুম্‌-ই-জাহানিয়া নামে বিখ্যাত ছিলেন। হিন্দুদের তো তিনি চরম ঘৃণা করতেনই, এমনকি মুসলমানদের মধ্যে জমে ওঠা হিন্দু সংস্কারগুলির (যেমন শব-এ-বরাত, যা দীপাবলির অনুকরণ ছাড়া বাস্তবে আর কিছুই নয়) বিরুদ্ধে তিনি প্রচার চালাতেন। তিনি ফিরোজ শাহ তুঘলকের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতেন। গুজরাটে বহু সম্ভ্রান্ত হিন্দুকে তিনি বাধ্য করেছিলেন ইসলাম গ্রহণ করতে। তাঁর পুত্র ও পৌত্র একই কাজ করে গেছেন বংশ পরম্পরায়। 

ফেরদৌসীয়া: এই শাখার উদ্ভব হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। এদের মধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির তীব্র প্রভাব ছিল। এই শাখার সবচেয়ে বিশিষ্ট সূফী ছিলেন শেখ শরাফুদ্দিন আহমেদ বিন ইয়াহিয়া মনাইরী। তিনি প্রথম জীবনে অরণ্যে কঠিন সাধনায় রত ছিলেন। তার পত্রাবলী থেকে জানা যায়, তিনি শিক্ষক ও আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তিনি গোঁড়া মুসলিমদের নজরে পড়েন। শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক গোঁড়া মুসলিমদের দিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে থাকেন ও তাঁর একাধিক বন্ধু ও সমগোত্রীয় সূফীকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেন। শেখ শরাফুদ্দিন তাঁর পত্রে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, সে শহরে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে, তা কীভাবে আল্লাহ্‌র হাতে ধ্বংস না হয়ে টিকে থাকতে পারে! তিনিও নিহত হতেন, কিন্তু মখদুম-ই-জাহানিয়ার হস্তক্ষেপের ফলে তিনি বেঁচে যান। এরপর সারা জীবন তিনি চুপ থাকেন। 

নক্সবন্দী শাখা: এই শাখার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খ্বাজা আহমেদ আতা ইয়েসবী। ১১০০খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশেই তিনি এই শাখার প্রতিষ্ঠা করেন। এরাও হিন্দু-বৌদ্ধ মতাদর্শের দ্বারা চূড়ান্তভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এই শাখার একাধিক বিখ্যাত সূফী ছিলেন যারা আধ্যাত্মিক শিক্ষক হিসাবে আদর্শ ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই মোট জনপ্রিয় হয় নি। কারণটা বুঝতে পেরেছিলেন সূফী আশ্রাফ জাহাঙ্গীর সামনানী। তিনি বুঝেছিলেন, এই শাখা শরিয়ত না মানার জন্যই জনপ্রিয় হচ্ছে না। রাজানুগ্রহ পাচ্ছে না। ফলে তিনি নরম শরিয়তী পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। তাতেও কাজ দেয়নি। প্রায় ২০০ বছর পর খ্বাজা বাকী বিল্লাহ সমস্ত ‘ঘৃণ্য’ পৌত্তলিক আচার-আচরণকে বর্জন করেছিলেন। এর পর স্বাভাবিকভাবেই রাজানুগ্রহ এবং জনপ্রিয়তা আসে। 

এই নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা না করে আমরা মূল বক্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। আমরা দেখলাম, যে সব সূফী ঘরানা ভারতে তাঁদের মত প্রচার করেছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই হিন্দু-বৌদ্ধদের ঘৃণার চোখে দেখতেন। তাদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করতেন, কখনো লোভ কখনো ভয় দেখিয়ে। এবং এই একই ফরমুলাতে তাঁরা রাজানুগ্রহ ও জনপ্রিয়তা লাভ করতেন। এবং যে সব সূফী তা না করতেন, তাঁদের তা করাতে বাধ্য করা হত। নয়ত তাদের বিলুপ্তি ঘটতো। 

ভারতে এইসব প্রচারক শ্রেণীর বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা দেখে নেব। বোঝার চেষ্টা করব, এদের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের সূফীদের বৈশিষ্ট্য কতটা ছিল। 

প্রথমত, প্রথম পর্যায়ের সূফীরা ইসলামের মূলধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন। কিন্তু এরা কখনই তা করেননি। নিজামুদ্দিন আউলিয়া বলেছেন, “উলেমারা যে কাজ করতে চান বক্তৃতা দ্বার , আমরা তা করে দেখাই আচরণ দ্বারা।” 

দ্বিতীয়ত, প্রথম পর্যায়ের সূফীরা শাসকশ্রেণীর নেক নজরে কোনোদিনই ছিলেন না। কিন্তু এঁরা শাসকশ্রেনীর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন ভারতকে ইসলামী রূপ দিতে।

তৃতীয়ত, প্রথম পর্যায়ের সূফীরা কখনই রাজনীতিতে মন দেননি। কিন্তু এঁরা সর্বদাই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। 

চতুর্থত, প্রথম পর্যায়ের সূফীরা ছিলেন মুলত শাসক শ্রেণী। কিন্তু এঁদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী ছিল। এবং ইসলামী শাসকদের তাঁরা সাহায্য করতেন অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। 

পঞ্চমত, প্রথম পর্যায়ের সূফীদের বিষয়বাসনা ছিল না। তারা ঘৃণাভরে সেসব প্রত্যাখ্যান করতেন। কিন্তু এঁরা যুদ্ধজয়ের পর ইসলামী শাসকদের কাছ থেকে গনিমতের প্রচুর সম্পদ গ্রহণ করতেন । 

সর্বোপরি, প্রথম পর্যায়ের সূফীরা ইসলামের মূলধারায় চলে আসা মুসলিমদের নিজ মতে দীক্ষিত করে মূলধারা থেকে সরিয়ে আনতে চাইতেন। কিন্তু ভারতের সূফীরা নিজ মতে দীক্ষিত না করে অমুসলিমদের ইসলামে দীক্ষিত করতেন। 

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, এদের আচরণ প্রথম পর্যায়ের সূফীদের ঠিক উল্টো। সূফী মত মূলধারার ইসলামের ষড়যন্ত্রের ফলে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়েছিল। ইসলামের ভেতরের বিদ্রোহী গোষ্ঠী পরিণত হয়েছিল ইসলাম প্রচারের মেশিনে। 

তারা যে ভারতে নিজেদের অনুগামীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। এই বিষয়ে আধুনিক কালের সমস্ত ঐতিহাসিক প্রায়ই ঐকমত্য পোষণ করেন। এই বিষয়ে এম এ খান এর ‘ইসলামিক জিহাদ’ গ্রন্থে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। 

(কাজের চাপে লেখার দিকে তেমন জোর দিতে পারছি না , তাই ভাষার কিছু ত্রুটি থেকে যেতে পারে , ত্রুটি মার্জনীয় ।) 

(ক্রমশ) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন