লিখেছেন গোলাপ
স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও মক্কাবাসী কুরাইশদের মধ্যে ইসলামের ইতিহাসের যে দ্বিতীয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটি ওহুদ প্রান্তে সংঘটিত হয়েছিল তার কারণ ও প্রেক্ষাপট, আক্রান্ত না হওয়া সত্ত্বেও আগ বাড়িয়ে নিজেদের আবাসস্থল মদিনা থেকে বের হয়ে ওহুদ প্রান্তে গিয়ে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে মুহাম্মদের বহু অনুসারীরা কী কারণে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং এই যুদ্ধে মদিনার ইহুদিদের ভূমিকা কেমন ছিল, তার বিস্তারিত আলোচনা আগের তিনটি পর্বে করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সালুল ও আরও প্রায় ৩০০ মুহাম্মদ অনুসারী (এক-তৃতীয়াংশ) মাঝপথ থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মুহাম্মদ তাঁর প্রায় ৭০০ জন অবশিষ্ট অনুসারীকে সঙ্গে নিয়ে ওহুদ প্রান্তে পৌঁছান। তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের (৭০৪-৭৬৮ সাল) বর্ণনা:
‘আল্লাহর নবী তাঁর অনুসারীদের যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ করেন, প্রায় ৭০০ জন মানুষ। তিনি আবদুল্লাহ বিন যুবায়েরের নামের বানু আমর বিন আউফ গোত্রের এক ভাইকে তীরন্দাজ বাহিনীর নেতৃত্বে নিয়োগ করেন। ঐ দিন আবদুল্লাহ বিন যুবায়েরের পরনে ছিল সাদা পোশাক, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল।
তাদের সাথে ছিল ৫০ জন তীরন্দাজ।মুহাম্মদ তাদেরকে বলেন, "তোমাদের তীরের সাহায্যে অশ্বারোহী বাহিনীকে আমাদের কাছ থেকে দূরে রাখবে এবং পেছন দিক থেকে তাদেরকে আমাদের কাছে আসতে দেবে না, তা যুদ্ধের ফলাফল আমাদের পক্ষে হোক অথবা বিপক্ষে। তোমরা ঐ স্থানেই থাকবে যাতে আমরা তোমাদের দিক থেকে আক্রান্ত না হই।"
তারপর আল্লাহর নবী দুইটি বর্ম-আবরণ (Coats of mail) পরিধান করেন এবং যুদ্ধের ঝাণ্ডাটি মুসাব বিন উমায়ের নামের বানু আমর গোত্রের এক ভাইয়ের হাতে দেন।
তারপর তিনি তাঁর তরবারি হাতে নেন এবং তা ঘুরিয়ে আস্ফালন (Brandish) করে বলেন, "তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে এই তরবারির যোগ্য?"
উমর তা নেয়ার জন্য উঠে দাঁড়ান ও বলেন," আমি এটি নেয়ার যোগ্য", কিন্তু আল্লাহর নবী ঘুরে দাঁড়ান এবং দ্বিতীয় বার একই বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে তা ঘুরিয়ে আস্ফালন করেন।
তারপর আল-যুবায়ের বিন আল-আওয়াম উঠে দাঁড়ান এবং তিনিও প্রত্যাখ্যাত হন। তারপর বানু সায়েদা (Banu Sa'ida) গোত্রের দুযানা সিমাক বিন খারাশা (Dujana Simak b. Kharasha) নামের এক ভাই উঠে দাঁড়ান ও তা গ্রহণ করেন।
তিনি [আবু দুযানা] জিজ্ঞাসা করেন, "হে আল্লাহর নবী, এটি গ্রহণের যোগ্যতা কী?"
তিনি জবাবে বলেন, "তা এই যে, এটি দিয়ে তুমি শত্রুদের আঘাত/বধ (Smite) করতেই থাকবে যতক্ষণ না এটি বেঁকে যায়।"
যখন তিনি বলেন যে, তিনি এটি গ্রহণ করে তার মর্যাদা রাখবেন, তিনি তা তাকে দেন। আবু দুযানা ছিলেন সাহসী কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দাম্ভিক। যখনই তিনি তাঁর লাল পাগড়িটি পরিধান করতেন, জনগণ জানতেন যে, তিনি যুদ্ধে প্রস্তুত।’ --- [1][2][3]
ঐ দিন মুহাম্মদ অনুসারীদের সিংহনাদ ছিল, "হত্যা কর, হত্যা কর"!’ [4]
(The companions’ war-cry that day was "Kill, Kill!")!
অন্যদিকে,
বদর যুদ্ধে আবু সুফিয়ান বিন হারবের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওতবার পিতা ওতবা বিন রাবিয়া ও তাঁর চাচা সেইবা বিন রাবিয়া এবং ভাই আল-ওয়ালিদ বিন ওতবা যেমন "তোমাদের সাথে আমাদের কোনোই বিবাদ নেই" ঘোষণা দিয়ে আনসারদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাননি (পর্ব-৩২), তেমনই ওহুদ যুদ্ধেও আবু সুফিয়ান ও তাঁর সহকারীরা আনসারদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাননি!
যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে আবু সুফিয়ান যুদ্ধে আগত মুহাম্মদ অনুসারী আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের উদ্দেশে এক বার্তাবাহক পাঠান। বার্তাবাহক মারফত তিনি তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, তাঁরা এসেছেন তাঁদের যাবতীয় দুরবস্থার জন্য যে-ব্যক্তিটি দায়ী, সেই মুহাম্মদের সাথে মোকাবেলা করতে; তাদের সাথে যুদ্ধ করতে নয়!
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের বর্ণনার পূর্বানুবৃত্তি (Continuation):
'কুরাইশরা তাদের লোকদের জড় করেন। প্রায় ৩০০০ জন মানুষ, তাদের সাথে ছিল ২০০ টি ঘোড়া। বাম পার্শ্বের অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন খালিদ বিন আল-ওয়ালিদ এবং ডান পার্শ্বের অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ইকরিমা বিন আবু-জেহেল। ---
‘তখন আবু সুফিয়ান এই খবর জানিয়ে এক বার্তাবাহক পাঠান,
"হে আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা, আমাকে আমার জ্ঞাতি ভাইয়ের (Cousin) সাথে মোকাবেলা করতে দাও, তারপর আমরা তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। কারণ তোমাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারা তাকে অভদ্র জবাব দেয়।” ----
(Now Abu Sufyan had sent a messenger saying, 'You men of Aus and Khazraj, leave me to deal with my cousin and we will depart from you, for we have no need to fight you'; but they gave him a rude answer.)
বানু আবদ-দার গোত্রের লোকেরা ছিল যুদ্ধের ঝাণ্ডা বহনকারী দল। তাদেরকে যুদ্ধে উদ্দীপ্ত করার জন্য আবু-সুফিয়ান বলেন, "এই যে বানু আবদ-দার, বদর যুদ্ধের দিন তোমাদের দায়িত্বে ছিল এই যুদ্ধ-ঝাণ্ডা - তোমরা জানো যে, সেদিন কী হয়েছিল। জনগণ নির্ভর করে যুদ্ধ-ঝাণ্ডার ভাগ্যের ওপর। তাই তোমরা হয় তা দক্ষতার সাথে অবশ্যই রক্ষা করবে, নতুবা তা আমাদের হাতে অবশ্যই সোপর্দ করবে - আমরা (তা রক্ষার দায়িত্ব থেকে) তোমাদের ঝামেলা মুক্ত করবো।"
বিষয়টির বিবেচনায় তারা অপমানিত বোধ করে এবং তাঁকে ধমক দিয়ে বলে, "তুমি কি চাও যে, আমরা আমাদের এই ঝাণ্ডা তোমাকে সমর্পণ করি? আগামীকাল যখন যুদ্ধ শুরু হবে, তখন দেখবে, আমরা কীরূপে যুদ্ধ করি," - আবু সুফিয়ান এটিই চেয়েছিলেন। --
যখন দুই পক্ষ একে অপরের নিকটবর্তী হয়, হিন্দ বিনতে ওতবা তাঁর সঙ্গের মহিলাদের নিয়ে উঠে দাঁড়ান ও সৈন্যদের পেছনে পেছনে যে খঞ্জনিগুলো তারা সৈন্যদের উদ্দীপ্ত করার জন্যবাজাচ্ছিল, তা তুলে নেন ও বলতে থাকেন:
"হে আবদ-দার এর দারক,
তোমরা আমাদের রক্ষক,
প্রতিটি শাণিত বল্লম দ্বারা করো তাদের আঘাত!"
তিনি আরও বলেন,
"যদি তোমরা হও আগুয়ান বাঁধিব আলিঙ্গনে,
বিছাইব মোরা কোমল গালিচা তোমাদেরই পদতলে;
যদি তোমরা হটো পিছু জানাবো মোরা বিদায়,
এমনই বিদায় যেথায় মোদের কোনো ভালবাসা আর নাই।"’ [5] [6]
>>> পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, বদর যুদ্ধে মুহাম্মদ অনুসারীরা কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বিন হারব ও তাঁর স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওতবার এক জোয়ান পুত্র হানজালাকে করেন খুন ও আর এক পুত্র আমরকে করেন বন্দী (পর্ব-৩৭)।
শুধু তাঁদের সন্তান হানজালাকেই নয়, মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা বদর প্রান্তে হিন্দ বিনতে ওতবার পিতা ওতবা, চাচা সেইবা ও ভাই আল-ওয়ালিদকেও নৃশংসভাবে খুন করেন (পর্ব-৩২)।
তা সত্ত্বেও, এই মহীয়সী মহিলাটি একই দিনে তাঁর নিজ পুত্র, বাবা, চাচা ও ভাইয়ের খুনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী মুহাম্মদের মক্কায় অবস্থিত কন্যা জয়নাবকে পরম স্নেহ ও সমবেদনায় সর্বাত্মক সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন (পর্ব-৩৯)।
স্বজনহারা শোকাবহ সেই মহীয়সী হিন্দ বিনতে ওতবা আজ যুদ্ধের ময়দানে! তিনি এসেছেন তাঁর পিতা, পুত্র, ভাই ও চাচার খুনের প্রতিশোধ নিতে।
একই ভাবে ইকরিমা বিন আবু-জেহেল এসেছেন তাঁর পিতা আবু জেহেলের হত্যার প্রতিশোধ নিতে! কুরাইশ নেতা আবু জেহেলকে কীরূপ নৃশংসতায় বদর যুদ্ধে খুন করা হয়েছিল, তার বিস্তারিত আলোচনা পর্ব বত্রিশে করা হয়েছে।
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:
[2] “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৭,ইংরেজী অনুবাদ: W. Montogomery Watt and M.V. McDonald, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭ – পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩৯৮,
[3] Ibid আল-তাবারী - পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩৯৪
[4] Ibid মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (ইবনে হিশামের নোট) - পৃষ্ঠা ৭৫৩
[5] Ibid মুহাম্মদ ইবনে ইশাক - পৃষ্ঠা ৩৭৪
[6] Ibid আল-তাবারী - পৃষ্ঠা (Leiden) ১৩৯৯-১৪০০