লিখেছেন মুখফোড়
হাবিল আর কাবিল দুই ভাই। হাবিল ভেড়া চরায়, কাবিল চাষবাস করে। ফসল উঠলে কাবিলের বউ পায়েস রাঁধে, পোলাও করে, আর হাবিলের বউ ভেড়ার মাংস কাঠিতে গেঁথে পোড়ায়। তারপর দুই ভাই বউপোলাপান নিয়ে বসে খায় গপাগপ।
এভাবেই চলছিলো দিন, হঠাৎ একদিন এক স্বর্গদূত এসে হাজির।
হাবিল কাবিল স্বর্গদূতদের খুব একটা পছন্দ করে না, ঈশ্বরের বার্তা নিয়ে আসে এরা, সে-ই ঈশ্বর যে তাদের বাবাকে পাছায় লাথি মেরে নন্দন কানন থেকে বার করে দিয়েছিলো, কী না কী একটা ফালতু ফল খাওয়ার সামান্য অপরাধে। ঐরকম বদমেজাজী ঈশ্বরদের কাছ থেকে শতহস্ত দূরে থাকাই শ্রেয়, ভাবে হাবিলকাবিল।
স্বর্গদূত এসে শোঁ শোঁ করে শ্বাস টানে নাক দিয়ে। "আরেব্বাহ, কী বাস ছাইড়েছে!" উৎফুল্ল গলায় বলে সে। "অ হাবিলদা, অ কাবিলদা, ভাবীছাবেরা পোলাও রাইনছে নি?"
হাবিল বলে, "হুঁ, কিন্তু তোমারে দিমু না।"
স্বর্গদূত হাসে গ্যালগ্যাল করে। "আরে তুমাদের এই পোলাও কি আমার প্যাটে সইবে গো? কিন্তু আমারে না দিলে, ঈশ্বরকে তো ভেট দিতে হবে দাদারা!"
কাবিল বলে, "ক্যান ক্যান ক্যান?"
স্বর্গদূত খিলখিল করে হাসে, "কী বোকাচো-- তুমি! ঈশ্বরের দুনিয়াতে থাইকতেছো খাইতেছো, আর তারে ভেট দিবা না? কাইলকে বেহানবেলা বড় মাঠে গিয়ে যার যার ভেট রাইখে আইসতে হবে, বুইলে পাঠিয়েছেন ঈশ্বর!"
স্বর্গদূত গম্ভীর হয়ে যায়। "ভেট না দিলে কী হবে তা তুমাদের বাপ আদমরে গিয়ে জিগাইস করো!" এই বলে ডানা মেলে উড়ে যায় সে।
হাবিল কাবিল নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে শলা করে। এরকম মস্তান ঈশ্বরের সাথে ঝামেলায় না গিয়ে ভেট দেয়াই মনস্থির করে তারা।
পরদিন কাকভোরে হাবিল নিয়ে যায় কাঠিতে গাঁথা এক কুড়ি মাংসের কাবাব, আর কাবিল নিয়ে যায় এক হাঁড়ি পোলাও। মাঠে সেগুলি রেখে তারা চুপিচুপি চলে আসে।
সকালে গিয়ে হাবিল দ্যাখে, তার কাঠিগুলোই পড়ে আছে, কাবাব উধাও। আর কাবিল গিয়ে দ্যাখে, তার হাঁড়ির পোলাও যেমনি ছিলো তেমনি আছে।
বাড়ি ফিরে হাবিলকাবিল যার যার বউকে খবর দ্যায়। হাবিল বলে, "ও হাবলুর মা, শুনছনি, আমার কাবাব তো ঈশ্বর কবুল করছেন।"
কাবিল বলে, "কাবলুর মা, কী বালের পোলাও রানছিলা, ঈশ্বর কবুল করলো না?"
হাবিলের বউ বেরিয়ে এসে এক চক্কর নেচে বলে, "দ্যাখতে হবে না, কে কাবাব পোড়াইছে? ঈশ্বর কবুল না কইরা যাইবো কই?"
কাবিলের বউ চটেমটে বেরিয়ে এসে বলে, "বলি ও আদমের পো, রোজ রোজ তো এই পোলাও পাতিল চাইছা খাও, তোমার তো মুখে ঠিকই রোচে, ঈশ্বর ক্যান কবুল করলো না তার আমি কী জানি?"
হাবিলের বউ কটাক্ষ করে, "আমার কাবাবের কাছে কি অর পোলাও ঠ্যাকে নাকি? কিয়ের লগে কিয়ের তুলনা, চান্দে আর বান্দরের পোন্দে!"
কাবিলের বউ তেড়ে যায়, "অই আবাগীর বেটি, মুখ সামলাইয়া কথা কবি! ম্যাড়ার মাংস সবাই পোড়াইতে পারে, পারলে পোলাও রাইন্ধা দ্যাখা!"
এভাবে প্রবল এক কাজিয়া শুরু হয়ে যায়, হাবিলের বউ কাবিলের বউ চুলাচুলি শুরু করে, ক্রমে হাবিল আর কাবিলও ট্যাগ টীম পার্টনার হিসেবে তাতে যোগ দ্যায়, আর চাষবাস করে পোক্ত কাবিল অলস ভেড়াচারক হাবিলকে পর্যুদস্ত করে ফেলে, এবং টাঙ্গির কোপে তাকে হত্যা করে। হাবিল কাবিলের যৌথ পরিবারে নেমে আসে এক কালো ছায়া।
কাবিল হাবিলের লাশটা নিয়ে কী করবে বুঝে পায় না। শেষে তার মনে পড়ে, হাবিল ছোটবেলায় মারপিটের সময় হাঁক ছাড়তো, "একদম গাইড়া ফালামু তরে, খানকির পুলা, একদম গাইড়া ফালামু!" সে দাঁতে দাঁত পিষে একটা কোদাল নিয়ে রওনা হয় বড় মাঠের দিকে, হাবিলের লাশটাকে সে একেবারে আলুর বীজের মতো পুঁতে ফেলবে।
মাঠে গিয়ে কয়েক কোপ কোদাল হাঁকাতেই হঠাৎ চারিদিক প্রকম্পিত করে এক কনঠস্বর বলে ওঠে, "আদমপুত্র কাবিল, এ তুমি কী করেছো?"
কাবিল ভয়ে কেঁপে ওঠে, এই রে, ঈশ্বর ব্যাটা এসে হাজির। মুসিবৎ! সে কোদাল নামিয়ে রেখে বলে, "প্রভু, গর্ত করি!"
ঈশ্বর বলেন, "আবঝাব কথা রাখো কাবিল। হাবিলকে হত্যা করলে কেন?"
কাবিল বলে, "না না প্রভু, হাবিলকে আমি হত্যা করি নাই। আমি ওকে নিয়ে বউদের ঝগড়া থামাতে গিয়েছিলাম, কিন্তু আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা আমাদের উপর এলোপাথাড়ি হামলা করে, এক পর্যায়ে পালাতে গিয়ে ক্রসকোপে হাবিল নিহত হয়!"
ঈশ্বর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, "ক্রসকোপ?"
কাবিল ঢোঁক গিলে বলে, "হাঁ প্রভু!"
ঈশ্বর এবার রাগে ফেটে পড়েন, "তুমি কি আমাকে বেকুব পেয়েছো নাকি কাবিল? পৃথিবীতে তুমি প্রথম নরহত্যা শুরু করেছো হে ভাতৃঘাতী কাবিল, আবার খোঁড়া অজুহাত দিয়ে ঈশ্বরের চোখে ধূলো দিতে চাও? রোসো, দেখাচ্ছি মজা! শুনে রাখো কাবিল, আজ থেকে তুমি হবে যাযাবর। তোমার পাপ তোমাকে তাড়া করে ফিরবে। তুমি হাবিলের লাশ লুকিয়ে রাখতে পারবে না, আমৃত্যু এই লাশ তোমাকে তাড়া করে ফিরবে! তোমার জীবন হবে অভিশপ্ত শৃগালের! ... আর আমার সাথে এই ক্রসকোপের গপপো ফাঁদার শাস্তি তুমি পাবে ইহকাল শেষ হলে, ব্যাটা ফাজিল!"
কাবিল বিমর্ষ মুখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বাড়ি ফিরে যায়, আর ভাবে, এই মেয়েমানুষ সব নষ্টের গোড়া! কী একটা মুসিবতে পড়া গেলো! রাগে তার শিরোভাগ তপ্ত হয়ে ওঠে, বউ আর ভাবীকে পিটানোর জন্য সে বাঁশঝাড় থেকে কয়েকটা কঞ্চি ভেঙে নেয়।