আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

রাজা-বাদশার গল্প

লিখেছেন শেখ মিলন

রাজা-বাদশা! না মধ্যযুগের কোনো ভূখন্ডের সম্রাট নয়, আমার রাজা-বাদশা। আমার রাজা-বাদশা দু'টি নিরীহ পশু। গৃহপালিত পশু। দু'টি খাসি ছাগল। 

কতোজনেই তো কতো কিছু নিয়ে গান, ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক রচনা করে। আমি নাহয় দু'টি অবলা, নিরীহ পশুকে নিয়েই কিছু কথা লিখছি। এবার মূল কথায় যাই -

নিম্ন-মধ্যবিত্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম আমার। আমার সৎ ও ধার্মিক বাবা স্বল্প বেতনের সরকারী চাকুরিজীবী এবং মা গৃহিণী। সর্বদা আমাদের সংসারে অর্থের অভাব-অনটন লেগেই থাকে। তবে তা শুধুই অর্থের, ভালোবাসার নয়। দুই ভাই-বোনের পড়াশোনার জন্য বেশ অনেক টাকাই খরচ হয়। তাই অভাবের সংসারে দিনে একবেলা ডিম, সপ্তাহে দু'দিন মাছ, আর মাসে দু'দিন মুরগির মাংস হলেই আমরা খুশি। বছরে দু-চার বার গরুর মাংস নেওয়া হয় দুই ঈদে, শবেবরাতে আর বিশেষ কোনো দিনে। ইসলাম ধর্মে শূকরের মাংস হারাম, তাই কেনা তো দূরের কথা, কখনো অমনটি পরিবারের কেউ কখনো ভাবেও না। বছরে তিনবার কাপড় কেনা হয়, দুই ঈদে আর অন্য কোনো এক সময়। মাসের ১৫ দিন পেরুলেই মার হাতে আর খুব বেশি টাকা থাকে না। ফেব্রুয়ারি মাসে দুটো দিন কম থাকাতে মা একটু হলেও স্বস্তি পায়। হয়তো একটু বাড়তি আয়ের জন্যই মা আমাদের বাড়িতে হাস-মুরগি আর ছাগল পালতেন। বরাবরই আমরা ছাগল বিক্রি করে দিই।

সেবার কনকনে শীত। ১৩ই ডিসেম্বর। সকালবেলা কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূয্যিমামা তখনও উঁকি দেয়নি। আমাদের পোষা ধাড়ি ছাগলটির দু'টি বাচ্চা হলো। দু'টোই খাসি। যদিও তখন কাটান দেওয়া হয়নি, তাই পাঁঠা বলাও চলে। বাড়ির সকলেই খুশি, তবে আমি আর আমার ছোটবোন তো মহাখুশি। আমি বাচ্চা দু'টোর নাম রাখলাম রাজা ও বাদশা।

মায়ের দুধে বাচ্চা দু'টোর পেট ভরতো না, তাই তাকে গরুর দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন। তবে শহরে হঠাৎ করে দুধের উটানা বা রোজ পাওয়া মুশকিল। আমাদের দুই ভাই-বোনের জন্য অবশ্য দুধের একটি রোজ ছিলো। একদিন আমি খেতাম তো পরেরদিন ছোট বোন। যখন আর নতুন রোজ পাওয়া গেলো না, তখন আমাদের রোজের ঐ দুধই বাচ্চা দু'টোকে খাওয়ানো শুরু করলো। বাড়ির একমাত্র এবং বড় ছেলে হওয়াতে সংসারের অনেক কাজই আমাকে করতে হতো, তাই এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, বাচ্চা দু'টোর দুধ খাওয়ার সুবিধার্থে আমিই একটি ফীডার কিনে আনলাম।

সেবার প্রচণ্ড শীত পড়েছিলো। ছাগলের ঘরে অন্য ছাগলের সাথে বাচ্চা দুটোকে রাখা আর ফ্রিজে রাখা সমান। আমাদের বাড়িতে তখন ফ্রিজ ছিলোনা, আজও নেই। তাই আম্মা সিদ্ধান্ত নিলেন, বাচ্চা দু'টো আমাদের সাথেই বিছানাতে থাকবে, পুরোনো লেপের ভেতরে।

আগেই বলেছি, আমাদের বাড়িতে ভালোবাসার কমতি নেই, হোক তা মানুষের প্রতি বা পশুর প্রতি। আমি আর আমার বোন তো মাঝে-মাঝে ছাগলছানা দু'টোকে এভাবে কোলে নিতাম যে, তা মানবশিশু না ছাগশিশু তা বোঝার উপায় থাকতো না। পরম আদর-যত্নে বড় হতে লাগলো বাচ্চা দু'টো। ওহ্, বলাই হয়নি, ওদের জন্মের এক সপ্তাহ পরেই কাটান দেওয়া হয়েছিলো।

আমরা ওদের রাজা-বাদশা বলে ডাকতাম। রাজা পুরোটা কালো আর বাদশা সাদা-কালো চক্রাবক্রা ছিলো, পুরো মুখ কালো আর তার মাথার দু'শিংয়ের মাঝে ছিলো একটুখানি সাদা।

তারা বুঝতে পেরেছিলো তাদের নাম রাজা-বাদশা। নাম ধরে ডাকলেই তারা ছূটে কাছে চলে আসতো। আমি কাছে ডেকে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিতাম আর ছাগল দু'টোর সাথে গল্প করতাম। আমাদের বাড়িতে একটি কদমগাছ ছিলো (এখনও আছে); ছোট বোন কোথা হতে জানি চারাগাছটি তুলে এনেছিলো, আমি বাড়ির এক কোণে তা পুঁতে দিয়েছিলাম। যেহেতু বোন গাছটি এনেছিলো, তাই গাছটি আমার বোনের। সে আমাকে তার ঐ গাছের ফুল-পাতা পাড়া তো দূরের কথা, হাতই লাগাতে দিতো না। বোন যখন থাকতো না (স্কুলে বা প্রাইভেট পড়তে যেতো), তখন আমি চুরি করে ঐ গাছ থেকে পাতা পেড়ে রাজা-বাদশাকে খাওয়াতাম।

আমাকে, মাকে বা বোনকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখলেই ওরা ম্যা-ম্যা করে ডেকে উঠতো। মা বলতেন, এভাবে নাকি ওরা জিজ্ঞেস করে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমি সবসময়ই একটু রাত জেগে পড়তাম, সে কারণে সকালে আমার ঘুম ভাঙতে দেরি হতো। আমি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে দেখতাম রাজা বা বাদশা কেউ একজন আমার পিঠের ওপরে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে পিঠ আঁচড়াচ্ছে, অপরজন আমার ডান বা বামপাশে শুয়ে আছে । আমি মাকে বলতাম, "মা, তোমার ছাগল একলাফে আমার বিছানায় ওঠে কেন? পা দিয়ে আমার গা আঁচড়ায় কেন?"

মা হেসে বলতেন, "বাবু, তুই ঘুম থেকে উঠতে দেরি করিস, তাই ওরা তোকে ডাকতে যায়, বলে বাবু আমাদের ঘুম ভেঙে গেছে, তুমি এখনো ঘুমোচ্ছো কেন?" আমি কিছুটা বিরক্ত হতাম. তবে খুব খারাপ লাগতো না।

কুকুর প্রভুভক্ত ও বিশ্বস্ত প্রাণী হলেও নাপাক বলে আব্বা কখনো বাড়িতে কুকুর পুষতে দেননি।

আমি আর বোন খাওয়ার শেষে প্লেটে একমুঠো করে ভাত রাখতাম আর তা রাজা-বাদশাকে খেতে দিতাম। আমার ছোট বোন তো দু'টো বিস্কুট খেলে, আমাকে না দিলেও রাজা-বাদশাকে একটা ভাগ করে দিতো। 

একবার কে জানি আমার বাদশার পায়ে ধারালো কিছু দিয়ে একটা কোপ দিয়েছিলো, অনেক রক্ত বেরিয়েছিলো, বাদশা হেঁটে বাড়ি আসতে পারছিলো না। ওখানেই দাঁড়িয়ে ম্যা-ম্যা করছিলো, আর রাজা ম্যা-ম্যা করতে করতে বাড়িতে আসে আমার মার কাছে, আবার বাদশার কাছে দৌড় দেয়। আরেকটা ছাগল কই ভেবে আম্মাও যায় রাজার পিছে-পিছে। গিয়ে দেখে রাজার পা বেয়ে রক্ত পড়ছে আর রাজা করুণ চোখে আমার মার দিকে তাকিয়ে ম্যা-ম্যা করছে। যেন মনে হয়, সে মাকে কেঁদে কেঁদে বলছে, "মা গো. আমাকে মেরেছে।"
মা আমাকে ডাকলেন। আমি বাদশার পায়ের ক্ষতস্থানটিতে আমার রুমাল বেঁধে কোলে নিয়ে রাস্তায় উঠলাম, রিকশা নিয়ে সোজা পশু হাসপাতালে গেলাম। বাদশার পায়ে ৪টা সেলাই হলো। বেশ কিছুদিন লেগেছিলো তার ক্ষত সারতে।

ওদের কখনো জোর করে ধরে-বেঁধে ওষুধ খাওয়াতে হয়নি। ওষুধ পানিতে গুলে সিরিঞ্জ (সুঁইটুকু খোলা) ভর্তি করে ডাকলেই ছুটে আসতো। আমি সিরিঞ্জটি উঁচিয়ে ধরলেই তা মুখের ভেতরে নিতো আর আমি পিচকারির মতো ওষুধটুকু মুখে ঠেলে দিতাম।

একবার আমি পড়তে বসেছি ছোট বোন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বললো, "জানিস, ভাইয়া, রাজা-বাদশার শিং উঠেছে।"

আমি "কই" বলে দৌড় দিলাম। গিয়ে দেখি, ওদের মাথায় ছোট্ট দু'টি করে শিং! আমার কী যে ভালো লাগছিলো, তা বলে বোঝানোর নয়। ওদের দাঁত ওঠার পর মুখটা ধরে বলতাম, "হাঁ করো তো, বাবু, দেখি তোমার দাঁত কতো বড়ো হয়েছে?"

আমাদের বাড়িতে রাজা-বাদশা ছাগল নয়, মানুষের মতোই বড়ো হয়েছে। মায়ের কাছে সন্তানের মতো, আর আমাদের দুই ভাই-বোনের কাছে ভাইয়ের মতো আদর পেয়েছিলো রাজা-বাদশা। ছোট বোন তো হাতে মেহেদি দিলেই, বাদশার মাথার সাদা অংশে মেহেদি লাগিয়ে দিতো। কালোর মাঝে ওই লাল অংশটি দেখতে চমৎকার লাগতো।

তবে রাজা-বাদশা কখনো আমার আব্বার ধারে-কাছেও ভিড়তো না। আব্বাকে খুব ভয় পেতো, আমার আব্বা একটু রাগী কিনা, তাই। আমরা দুই ভাই-বোনই আব্বাকে খুব ভয় পাই, আর ওরা তো পাবেই।

একদিন জুম্মার নামায পড়ে এসে আব্বা বললেন, "এই কোরবানির ঈদে খাসি দু'টি কোরবানি করবো। খুতবায় হুজুর বলেছেন, "কুরবানির জন্য উত্তম পশু হলো ছাগল, দুম্বা, মেষ বা ভেড়া। এ ছাড়াও গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ, তবে তা উত্তম নয়।" (ইবনে মাজাহ হা: নং ৩১৪৭)

আর হুজুরের (মসজিদের ইমাম) সাথে আলাপ হয়েছে, তিনি বলেছেন, দু'টিই কোরবানি করা যাবে (যেটির পা কেটে গিয়েছিলো সেটিও)।

আমার আর ছোট বোনের মন খারাপ। আম্মাকে বললাম, "কুরবানি না করলে হয় না, মা?"

মা বললেন, 'আল্লাহর বিধান, অমান্য করা যায় নাকি? সামর্থ্য থাকলেই কুরবানি দিতে হবে। হাদিসে আছে, "যে ব্যক্তি কুরবানী করার সামর্থ্য থাকার পরেও কুরবানী করে না, তবে সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।"[ইবনে মাজাহ, ৩য় খন্ড, ৫২৯পৃষ্ঠা, হাদিস: ৩১২৩]'

বলেছিলাম, "তাহলে পশু কিনে দাও।"

মা বললেন, ' হুজুর তোর আব্বাকে বলেছে, গৃহপালিত পশু কোরবানির সওয়াব বেশি।'

একে-একে ঘনিয়ে এলো কুরবানি ঈদের দিন। ঈদ মানে আনন্দ, তবে আমাদের দুই ভাইবোনের মনে সেবার একটুও আনন্দ ছিলো না। আমি নতুন কোনো কাপড় নিইনি, ছোটবোন হাতে মেহেদী দেয়নি। বারবার মনে হচ্ছিলো, আমার টাকা থাকলে, আমি আব্বার কাছ থেকে রাজা-বাদশাকে কিনে নিতে পারলে ভালো হতো...

কুরবানির দিন সকালবেলা, রাজা-বাদশা আমার ঘরে এলো, চুপ করে আমার মাথার কাছটাতে দাঁড়ালো। আমি দেখলাম ওদের চোখ ভেজা। আমার চোখ ভিজে গেলো। ওদের গায়ে হাত রাখলাম, গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করলাম। আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে বালিশটা ভিজছিলো। সেদিন উপলব্ধি করলাম, মানুষ পশুকে কতোটা ভালোবাসতে পারে, আর পশুও মানুষকে কতোটা ভালোবাসতে পারে।
আমার ছোটবোন হাউমাউ করে কাঁদছিলো।...

গোসল সেরে নামাজ পড়ে আসলাম। হুজুর আসলেন আমার ভাইদের জবেহ্ করতে। আব্বা হুকুম দিলেন ওদের নিয়ে আসতে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আব্বা ধমক দিলেন, আমি চোখ মুছতে মুছতে ওদের নিয়ে গেলাম। হুজুর ধারালো খঞ্জর বের করলেন, আমি শিউরে উঠলাম...

আমি ফিরে বাড়ি চলে আসছিলাম। হুজুর বললেন, "বাবা, তুমি বাড়ির বড়ো ছেলে, তুমি থাকো। রাসূল বলেছেন "হে ফাতেমা! নিজের কুরবানীর পশুর নিকট উপস্থিত থাক, কেননা যখন এটার রক্তের প্রথম ফোঁটা পড়ে, তোমার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।" [আস সুনানুল কবীর লিল বায়হাকী, ৯ম খন্ড, ৪৭৬ পৃষ্ঠা, হাদীস: ১৯১৬১]"

আমি থাকলাম। 
চারজন মানুষ (মানুষ কি না, তাতে সন্দেহ হচ্ছে) আমার রাজা-বাদশাকে চিৎ করে ফেলে দড়ি দিয়ে চার পা বেঁধে ফেললো। রাজা-বাদশা জোরে-জোরে ম্যা ম্যা করে চিৎকার করছিলো। হয়তো আমার মাকে ডেকে বলছিলো, "মা, বাঁচাও...মা, বাঁচাও..."

হুজুর "আল্লাহু আকবার" রব তুলে একে একে আমার ভ্রাতৃতূল্য দুই অবলা প্রাণীর গলায় অবলীলায় ছুরি চালিয়ে আল্লাহকে খুশি করলো। আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে বাড়িতে দৌড় দিলাম।

সেদিন সারাটা দিন আমি কিচ্ছুটি খাইনি, শুধু শুয়ে ছিলাম, আর আমার বোন সারাদিন কেঁদেছে, মা কাজের ফাঁকে আঁচলে চোখ মুছেছে। কোরবানির মাংসে নিজের যে-অংশটি থাকে, আমি সেটিও বিলিয়ে দিয়েছি। ওই মাংসের একটি টুকরোও মুখে তুলিনি।

ভাইয়ের মাংস। মুখে তুলি কীভাবে?

সেই থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমি জীবনে কখনো কোরবানি বা আকীকা দেবো না।

আপনারা হয়তো দু'টি ছাগল নিয়ে লেখার কারণে আমাকে পাগল বলবেন, তবুও আমি এটুকু ভেবে খুশি হবো, আমার রাজা-বাদশার কথা, আমার দু'টি অবলা ভাইয়ের কথা কেউ অন্তত জানলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন