আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ১৭)

লিখেছেন উজান কৌরাগ

পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫ > পর্ব ১৬

একটা প্রাইভেট হাসপাতালের আলট্রাসনোগ্রাম কক্ষের বাইরে হাঁটছি আর বোতল থেকে ঘন ঘন পানি খাচ্ছি প্রস্রাবের চাপ আনার জন্য, মাত্রই টেস্টের জন্য প্রস্রাব দিয়ে এলাম নিচতলায়, প্রস্রাবের চাপ না থাকায় আমার সিরিয়ালের পরের রোগীরা আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে চলে যাচ্ছে, আর আমি চাপ আনার জন্য কসরত চালিয়ে যাচ্ছি; তবু চাপ আসছে না, অথচ ঘন ঘন প্রস্রাবের জন্যই আমার ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। আলট্রাসনোগ্রামের জন্য প্রস্রাবের চাপ থাকতে হয় তা যদি জানতাম, তাহলে কি আর আগে প্রস্রাবের টেস্ট দিই, এখন বেকুবের মতো পানি গিলছি আর হাঁটছি। আমি একা নই আমার মতো আরো কয়েকজন পানি খাচ্ছে আর হাঁটছে।

শরীরটা কিছুদিন যাবৎ ভাল যাচ্ছে না; ঘন ঘন প্রস্রাব হচ্ছে, বুক-পেট জ্বলছে আর ব্যথা করছে। কাল বিকেলে এই হাসপাতালেই ডাক্তার দেখিয়ে গিয়েছি। ডাক্তার একগাদা টেস্ট দিয়েছে; সবগুলোই করিয়েছি, এখন বাকি শুধু আলট্রাসনোগ্রাম। কাল ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে প্রথমেই আমার নজরে পড়েছে প্রৌঢ় ডাক্তারের কপালের নামাজ পড়ার সহি দাগ, এরপর তার পেছনের দেয়ালে বাঁধাই করা আরবি হরফে লেখা আল্লাহ্। ডাক্তার বেশ সময় নিয়েই দেখলেন এ-গল্প-সে-গল্প করতে করতে। কী করি, কোথায় থাকি ইত্যাদি শুনলেন; রোগ ভাল হওয়ার ব্যাপারে ইনশাল্লাহ্-টাল্লাহ্ ব’লে আল্লাহ্’র ওপর ভরসা রাখার পরামর্শও দিলেন। মনে মনে বললাম, "ওরে বেকুব, আল্লাহ্’র ওপর ভরসাই যদি রাখবো তাহলে তোর কাছে এসেছি কেন, আর তুই যদি আমাকে আল্লাহ্’র ওপর ভরসাই করতে বলবি, তাহলে কষ্ট ক’রে ডাক্তারি পড়ে এখন এখানে রোগীর পকেট কাটতে বসেছিস কেন!" ডাক্তার হোক আর যা-ই হোক, আল্লাহ্ আর তার নবীর কাছে এদের মাথা বন্ধক রাখা যেন বাধ্যতামুলক! অথচ ডাক্তারিবিদ্যা রপ্ত করতে হয়েছে আল্লাহ্ আর তার নবীকে অমান্য ক’রে। মেডিকেলের পাঠ্যবইয়ে মানবদেহ এবং বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি নিয়ে স্টাডি করতে হয়েছে, নারী-পুরুষের দেহ কাটাছেঁড়া করতে হয়েছে! মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান বইয়ে বিভিন্ন প্রাণীর ছবি নিয়ে স্টাডি এবং তেলাপোকা-ব্যাঙ প্রভৃতি প্রাণী কাটতেও হয়েছে। তাছাড়া রুগ্ন ব্যক্তিকে মোহাম্মদ ঝাঁড়ফুঁক করতে বলেছেন। কেউ অসুস্থ হলে তিনি সুরা ফালাক আর সুরা নাস পড়ে তাকে ঝাঁড়ফুঁক করতেন। তিনি নিজে অসুস্থ হলে জিবরাঈল এসে ঝাঁড়ফুঁক ক’রে নাকি তাকে সুস্থ করতেন। তিনি যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তার বিবি আয়েশা সুরা ফালাক এবং সুরা নাস পড়ে তার গায়ে হাত বুলিয়েছিলেন, মোহাম্মদের হাত তার হাতের চেয়ে বেশি বরকতময় - এমন ধারণা থেকে কখনো কখনো তিনি দোয়া পড়তেন আর মোহাম্মদের হাত ধরে তার গায়েই বুলাতেন! এতে অবশ্য মোহাম্মদকে বাঁচানো যায়নি, নিজের আবিষ্কৃত দোয়া-দাওয়াই তার ক্ষেত্রেই কাজ করেনি; আর মৃত্যুপথযাত্রী মোহাম্মদকে ভুলে গিয়ে জিবরাঈল তখন বেহেশেতে রতিরঙ্গে বিভোর ছিল কি-না, কে জানে!



আল্লাহ্’র বান্দা পরম দয়ালু ডাক্তার আমার টেস্টে পঁচিশ পারসেন্ট ডিসকাউন্টের বিষয়টা প্রেসক্রিপশানে লিখে দিতে দিতে বললেন, ‘সবাইকে দিই না, কিন্তু আপনি স্টুডেন্ট, তাই টেস্টে পঁচিশ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট লিখে দিচ্ছি।’

ছয়শো টাকা ভিজিট দিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমি বাসায় ফেরার সময় ডাক্তারের দয়ার কথা ভাবছিলাম। তিনি রাজধানীর একটি সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার, দয়া ক’রে বেসরকারী হাসপাতালে মাত্র ছয়শো টাকা ভিজিটের বিনিময়ে রোগী দেখতে এসেছেন, টেস্ট দেখানোর সময় আবারো মাত্র তিনশো টাকা নেবেন, এরপর এক মাসের মধ্যে যতোবার আসবো, মাত্র তিনশো টাকা ক’রে নেবেন আর এক মাস পর এলে পুনরায় মাত্র ছয়শো টাকা নেবেন। আর এই যে তিনি আমাকে ডিসকাউন্ট দেবার পরও সব টেস্টের বিল বাবদ প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা দিলাম, এখান থেকেও তিনি দয়া ক’রে কমিশন গ্রহণ করবেন! ডাক্তারের অনেক দয়া!

আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে এখন বাসার দিকে হাঁটছি। সকালের ব্যস্ত রাস্তা-ফুটপাত, মানুষ হনহন ক’রে ছুটছে বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে। আজ এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। রক্ত দিতে গেলে আমার মতো একজন পরপুরুষের হাত স্পর্শ ক’রে রক্ত নিয়েছে বোরখা পরা ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের এক নারী; ইসিজি করাতে গেলে বদ্ধ রুমে চিৎ হয়ে বেডে শয়ান আমার মতো একজন পরপুরুষের বুকে-হাতে-পায়ে জেল মাখিয়ে দিয়েছে বোরখা পরা চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের এক নারী, তারপর ইসিজি শেষে যত্ন ক’রে মুছেও দিয়েছে জেল; আলট্রাসনোগ্রাম করাতে গেলে আমার মতো একজন পরপুরুষের তলপেটের প্যান্টের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে এক টুকরো কাপড় গুঁজে সারা পেটে জেল মাখিয়ে দিয়েছে বোরখা পরা ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এক নারী, শাড়ি পরিহিত অন্য একজন নারী আলট্রাসনোগ্রাম করার পর বোরখা পরা নারী যত্ন ক’রে আমার পেটের জেল মুছে দিয়েছে। বোরখা পরা থাকলেও তিনজনেরই মুখ ছিল অনাবৃত; ভ্রু প্লাক করা এবং ঠোঁটে লিপস্টিক, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। কোনো সন্দেহ নেই যে, অর্থের বিনিময়ে করলেও তারা সততার সঙ্গে একটি সেবামুলক কাজ করছেন এবং কাজটির প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। যে তিনজন নারী আমার শরীর স্পর্শ ক’রে তাদের কর্ম সম্পাদন করেছে, আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছি; কিন্তু প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার ভেতর থেকে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মায়নি তাদের স্বভাবের বৈপরীত্যের কারণে। কে কী পোশাক পরবে না পরবে, সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু কেউ যখন নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে কোনো বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর পোশাক প’রে সেই ধর্মটিকেই অবমাননা করে, তখন আর মানুষ হিসেবে তার প্রতি কোনো শ্রদ্ধা থাকে না। এই তিন নারীর প্রতিও আমি শ্রদ্ধাশীল নই এজন্য যে, তাঁরা যে কাজটি করছেন, সেটা তাদের ধর্ম অনুমোদন করে না। ইসলামে পরপুরুষকে স্পর্শ করা তো দূরের কথা, মুখ দেখানোও নিষেধ। অথচ ইসলাম অনুমোদিত পোশাক প’রে তারা অননুমোদিত কাজ করছে।

আজকাল বোরখাওয়ালীর সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে; রাস্তাঘাট, মার্কেট, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সিনেপ্লেক্সসহ সর্বক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক বোরখাওয়ালী চোখে পড়ে। পার্কে কিংবা একটু কম ব্যস্ত রাস্তায় প্রেমিকের গা ঘেঁষে বসে দিব্যি প্রেমালাপ করে বোরখাওয়ালীরা; অথচ ইসলামে অবিবাহিত নারী-পুরুষের মেলামেশা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমি দশ বছর আগেও রাস্তাঘাটে এতো বোরখাওয়ালী দেখিনি। শাশ্বতীদি বলে যে, দেড় দশক আগে শহরাঞ্চলে প্রতি দশজন মুসলিম নারীর মধ্যে একজন বোরখা কিংবা হিজাব পরতো, আর এখন প্রায় অর্ধেক; জায়গা বিশেষে সেটা আরো বেশি; ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও দশজনে আটজন। এটা অবশ্য কোনো সংগঠনের জরিপ নয়, শাশ্বতীদির নিজের জরিপ। দিদি সেই অনার্স পড়ার সময় থেকেই এনজিওর কাজে সারা দেশ চষে বেড়ায়; রাস্তাঘাটে চলার সময় সে নিজেই জরিপ চালিয়েছে।

মুসলিম নারীদেরকে বোরখা পরানোর জন্য ভেতরে ভেতরে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে পরকালের ভয়ভীতিসহ নানারকম ধর্মীয় ব্যাখ্যা এবং উপদেশের মাধ্যমে। শাশ্বতীদির বাসায় ঠিকা কাজ করে রোজিনা নামের বছর ত্রিশের এক নারী। রোজিনা মোহাম্মদপুরের একটা বস্তিতে থাকে রিক্সাচালক স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে। সেখানে তাদের পাশের ঘরে এক তরুণ হুজুর দম্পতি উঠেছিল কিছুদিনের জন্য। হুজুর দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরেই থাকতো, কখনো কখনো একটানা আট-দশদিন বাসায় থাকতো না। হুজুরের স্ত্রী কখনো স্বামীর সঙ্গে বাইরে যেতো আবার কখনো একাই; তবে বাসায়ই বেশি থাকতো সে। হুজুর বস্তির পুরুষদেরকে ধর্মোপদেশ দিতো, নিয়মিত এবং সময়মতো নামাজ পড়তে বলতো, বাচ্চাদেরকে মাদ্রাসায় পড়ানোর পরামর্শ দিতো। হুজুরের স্ত্রীও বস্তির নারীদেরকে বোরখা পরতে এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে বলতো, পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করতো। আমি রোজিনার মুখেই শুনেছি, ‘কনছেন বাইয়া, আমি ঠিকা বুয়ার কাম করি, এ বাসা ও বাসায় ছুডাছুডি করতে অয়, আমার বোরখা পরনের সময় আছেনি? বোরখা পরতে আর খুলতেই তো দিনের অর্র্ধেক যাইবো গা, কাম করুম কহন! হেই বেডি এক্কেরে নাছোড়বান্দার নাহাল লাগছে আমার পিছে। উঠতে-বইতে সালাম দিয়া বোরখা পরতে কয় আর পরকালের ডর দেহায়। ব্যাডা-বেডি দুইজনেই আইসা আমাগো বুজায় পোলা-মাইয়ারে মাদ্রাসায় দেওনের লাইগা, হ্যারাই নাকি খাওন-পরন দিবো, আমাগো এক পয়সা খরচ লাইগতো না। পোলা-মাইয়া মাদ্রাসায় পড়লে নাকি আমরা বেহেশতে যাইতে পারুম। টাহার কতা চিন্তা কইরা আমি খালি ওগো বাপরে একদিন কইছিলাম, “এতো কইরা কইতাছে দিবানি মাদ্র্রাসায়?”

হুইনা হ্যায় আমার ওপর খাঁড়া ধইরা উঠছে, “খাওন পরন দিতে না পারলে পোলা-মাইয়ারে গলা টিপ্প্যা মারুম, তাও মাদ্রাসায় পড়তে দিমু না। হুনতাছস না চারদিক কি অইতাছে, শ্যাষে জঙ্গি-মঙ্গি অইয়া পোলায় আমার র‌্যাবের গুলি খাইয়া মরবো!”

ব্যাডা আর বেডির জ্বালায় অহন পালাইতে মন চায়। এইডা করা হারাম, ওইডা করা গুনাহ্, সেইডা করা শিরক; দিনরাত কানের কাছে এইসব কইতে থাকে। আমি এক বৌদ্ধ পরিবারে কাম করি, বেডি আমারে রোজ হেই কাম ছাড়তে কয়। কয় ব’লে যে বৌদ্ধরা তো মূর্তি পূজা করে, হ্যাগো বাসায় কাম করলে তোমার গুনাহ্ অইবো; দোজখে যাইবা। তাছাড়া তুমি যহন হেই বাসায় কাম করো, বৌদ্ধ ব্যাডারা তোমার শরীরে কু-নজর দেয়; কোনো বিধর্মী কাফেরের বাড়িতে কাম করবা না। মুসলমানের বাসায় কাম করবা, বোরখা পইরা কামে যাইবা। কতার ছিরি শুনলে হাসিও আহে, দুঃখও লাগে! বোরখা পইরা ব’লে আমি কামে যামু; ঘর মুছমু, কাপড় ধুমু, বাথরুম পরিষ্কার করমু বোরখা পইরা! বিধর্মীগো বাসায় কাম করতে নিষেধ করে, হুইন্ন্যা দুঃখে গাও জ্বলে। আমার প্যাটে টিপ দিলে অহনও হিন্দুগো বাড়ির ভাত বাইর অইবো। আমার নানি আর আম্মায় জনমভর কাম করছে হিন্দুগো বাড়ি; মায় সাতসকালে কামে যাওনের সময় নিয়া গেছে, দিন ভইরা দেবুকাকার বাড়ির উঠোনে বইয়া হিন্দুপাড়ার মাইয়াগো লগে পুতুল খেলছি, ক্ষিদা লাগলে কাকিমায় মুড়ি-খই-নাড়ু খাইতে দিছে, দুপুরবেলায় আবার মায়ের সাথে বইয়া ভাত খাইছি, বৈকালে ফেরনের সময় আবার মায়ের কোলে চইড়া নয়তো মায়ের পিছে পিছে আম-জাম-পেয়ারা খাইতে খাইতে বাড়ি ফিরছি। দেবুকাকার বড় মাইয়ার পুরোন জামা-কাপড় পইরা বড় অইছি। আর ব্যাডায় আর বেডি আমারে কয় বিধর্মীগো বাড়িতে কাম করা হারাম!’

এর কিছুদিন পরই নাকি হঠাৎ একদিন সকালে সেই হুজুর আর তার স্ত্রী লাপাত্তা হয়েছিল, আর দু-দিন পরই তাদের সন্ধানে বস্তিতে পুলিশ গিয়েছিল।

এই ধরণের প্রচার-প্রচারণা কেবল সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই চালানো হয় না, সমাজের মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীতেও বোরখা পরার কিংবা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জোর প্রচারণা চালানো হয় এবং সাফল্যও আসে। যারা প্রচার চালায়, সবাই যে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, এমন না-ও হতে পারে। যেমন আমার চাচির কথাই বলি, চাচি তালিমের একটা গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা আমি কিছুদিন আগে জেনেছি আমার বন্ধু আবিরের কাছ থেকে। আবিরের বড় বোন মানে আমাদের নিত্রাদির মেয়ে আর আমার চাচাতো বোন ছোটটা দু’জনই সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত একটি স্কুলে পড়ে, দু'জনই ক্লাস ফাইভে, ডে শিফট-এ। সেই সূত্রে আর আমার সূত্রে নিত্রাদি এবং চাচি দু’জনই দু’জনকে চেনে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিত্রাদি-ই বলেছে আবিরকে। স্কুলটিতে অভিভাবকদের বসার জন্য বেশ পরিপাটি একটি অপেক্ষাগার আছে, আর অপেক্ষাগারের সাথেই ছোট্ট একটি রুম আছে, যেখানে বসে সাধারণত মায়েরা দুপুরের খাবার খায়। চাচি বোনকে নিয়ে স্কুলে যান আর একবারে ছুটির পর ওকে নিয়ে বাসায় ফেরেন। তিনি এবং অপেক্ষাগারের আরো সাত-আটজন নারী মিলে তালিমের একটি দল গঠন করেছেন। এরা অন্যান্য নারীদেরকে বোরখা পরার পরামর্শ দেয়, নারী-পুরুষে মেলামেশা করতে নিষেধ করে, নামাজ-রোজা রাখতে বলে, এই ধরনের আরো নানারকম ধর্মীয় বিধিনিষেধ ব্যাখ্যা করে। কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ এই গ্রুপটির প্রতি বিরক্ত হয় এবং এদেরকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে; এমনকি যারা বোরখা বা হিজাব প’রে স্কুলে যায় এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করে, তারাও! যেহেতু অপেক্ষাগারে দু'-চারজন পুরুষ মানুষও থাকে, তাই এরা নিজেদের মধ্যে ধর্মীয় আলোচনা এবং জিকিরের জন্য মায়েদের খাবারের ঘরটি দখল করে। কেউ সেখানে খেতে গেলে তারা এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ আর এমন ভাব প্রকাশ করতো যে, কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ সেখানে খেতে যাওয়া বন্ধ ক’রে দেয়। নিত্রাদি আর অন্য একজন মহিলা ওখানে খেতে গেলে চাচিরা তাদেরকে নিষেধ করেছিল ওখানে খেতে। যাইহোক, কোনোভাবে হয়তো খবরটা প্রিন্সিপালের কানে গিয়েছিল, কয়েকদিন পর তিনি নিজে এসে ওখান থেকে তালিমের দলকে তুলে দিয়ে পুনরায় মায়েদের দুপুরের খাবারের জায়গা হিসেবে নির্দিষ্ট ক’রে দেন ঘরটি। চাচিরা প্রিন্সিপালকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ধর্মীয় কথাবার্তা ব’লে তাকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি, প্রিন্সিপাল কঠোর ভাষায় জানিয়েছেন যে, এখানে কোনো তালিম চলবে না। এই ঘটনায় মর্মাহত চাচি আর তার সঙ্গীরা তাদের ভাষায় পথভ্রষ্ট প্রিন্সিপালের বিচারের ভার আল্লাহ্’র ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন আর এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে প্রিন্সিপাল নাস্তিক, আওয়ামীলীগ করে; তাদেরকে ঘর থেকে তাড়ানোর জন্য হাশরের ময়দানে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেনই! এখন নাকি তারা স্কুল ভ্যানের মধ্যে বসে দ্বীনের চর্চা করে। বাচ্চাদের স্কুলে ঢুকিয়ে স্কুলভ্যানে বসে বোরখাওয়ালীদের দ্বীনের চর্চা করা আমিও দেখেছি মিরপুর আইডিয়াল আর বিসিআইসি স্কুলের সামনে; কয়েকজন মিলে মোবাইলে ওয়াজ কিংবা ইসলামী গান শুনতে শুনতে তজবিহ্ গোনে আর ধর্মীয় আলাপ করে, আর চেষ্টা করে অন্যদেরকে দলে ভেড়ানোর।

বাসার গেট দিয়ে ঢুকে তালা লাগিয়ে দু'পা এগোতেই এরশাদুল ওর ঘরের সামনে হাজির, ‘ভাইজান, কাম তো একখান ঘইট্যা গেছে। হুনছেননি কিছু?’

আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম ওর দিকে, বাসায় আবার কিছু ঘটলো নাকি! অবশ্য ওর কথা বলার ধরনই এমন, দুর্ঘটনায় একশো মানুষ মরার সংবাদ জানানোর আগেও বলে কাম তো একখান ঘইট্যা গেছে, আবার কারো সন্তানের জন্ম হলে কিংবা পরিচিত কাউকে কোনো ছেলে বা মেয়ের সাথে রিক্সায় দেখলে সেই সংবাদ জানানোর সময়ও বলে কাম তো একখান ঘইট্যা গেছে! বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে, বল।’

‘আমাগো বুয়া আসমার বইন কয়মাস আগে সৌদি আরব গেছিলো, সৌদির ব্যাডারা তো বহুত বজ্জাত, হ্যারা নাকি তারে মারধর আর কী জানি কী করে! হ্যায় অহন দ্যাশে আওয়ার লাইগা বাড়িতে ফোন দিয়া খালি কান্দে। অহন দ্যাশেও আইতে পারে না, যে কোম্পানি তারে সৌদি নিয়া গেছে, তারা তো পাশপুট লইয়া আর ফেরত দেয় না।’

‘তোকে কে বললো?’

‘বাজার দিতে ওপরে গেছিলাম, দেহি আসমা বড় চাচীরে কইতাছে আর কানতাছে।’

‘আসমা বু তোর চেয়ে কম ক’রে হলেও দশ বছরের বড়, নাম ধরে ডাকিস কেন?’

‘ও ছরি, ভুল অয়া গেছেগা।’

আমি পা বাড়ালাম সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির একধাপ উঠতেই ও আবার বললো, ‘আসল মজার কতা তো কই-ই নাই, এদিকে কী অইচে জানেন, আসমা বু’র বইনের জামাই, হ্যায় নাকি কইয়া দিছে, বউরে তালাক দিবো। বউ দ্যাশে ফির‌্যা আইলেও নাকি হ্যায় আর তারে ঘরে নিবো না।’

‘এইটা কোনো মজার কথা হলো! একটা মেয়ে বিদেশে অসহায় অবস্থায় আছে, তার ওপর তার বর তাকে তালাক দেবে, এইটা শুনে কি তোর খুব মজা লাগছে?’

আমি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলাম। দরজা খোলা, বাসায় ঢুকে দেখি মা ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছেন, উল্টোদিকের সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে ছোট আপু, আর ডাইনিংরুমের মেঝেতে বসে তাদের কাছে দুঃখের ঝাঁপি খুলেছে আসমা বু। চোখে পানি নেই, তবে একটু আগে যে সে কেঁদেছে, তা বোঝা যাচ্ছে।

খবরের কাগজের ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছোট আপু বললো, ‘রিপোর্ট কখন দেবে?’

‘সন্ধ্যায়।’

আমি মায়ের পাশে বসলাম। মা বললেন, ‘ডাক্তার আজই দেখাবি না?’

‘হ্যাঁ।’

কিছুক্ষণ আসমা বু’র কথা শুনলাম। তারপর বললাম, ‘সৌদি আরবের মতো একটা অসভ্য ইতরের দেশে তোমার বোনকে পাঠিয়েছ কেন?’

ছোট আপু খবরের কাগজের ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকালো। আসমা বু বললো, ‘আমরা কি এতো কিছু জানিনি!’

‘জানবা কেমনে, সন্ধ্যা হলেই তো ভারতীয় সিরিয়াল দেখতে বসো টিভির সামনে, একটু খবর তো দেখবা না তোমরা। ঢাকা শহরে বাস করো, ঘরের মধ্যে টিভি আছে, তারপরও তোমরা জগতের কোনো খবর জানো না।’

‘ভাবতাম নবীজির দ্যাশের মানুষ নবীজির মতোই দয়ালু, অহন দেহি নবীজির দ্যাশের মানুষ মহা খচ্চর।’

‘তোমার নবীজির দেশের মানুষ নবীজির মতোই! এখন তোমার বোনকে বলো কোনোভাবে পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে পারে কি-না, আর এখান থেকে তোমার বাবা আর বরকেও যোগাযোগ করতে বলো।’

মা বুঝেছেন যে, তাদের প্রিয় নবীকে নিয়ে আরো দু'-চারটা কথা ব’লে ফেলতে পরি, তাই আসমা বু’কে বললেন, ‘যা, ঘরটা মুছে ফ্যাল।’

আমি নিজের ঘরে এসে জামা-প্যান্ট খুলে গামছা পরলাম আর জামা-প্যান্ট রেখে এলাম ময়লা কাপড়ের ঝুড়িতে, তারপর গোসলের উদ্দেশে বাথরুমে ঢুকলাম। ইসিজি আর আলট্রাসনোগ্রাম করার সময় বুকে-পেটে-হাতে-পায়ে আঠালো জেল মাখিয়েছিল, ঘা কেমন ঘিন ঘিন করছে। গোসল করতে করতে আমার কেবলই মনে পড়ছে আসমা বু’র বোনের কথা। কোনো সন্দেহ নেই যে, মেয়েটা সেখানে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গত চোদ্দশো বছরে পৃথিবীর কতো পরিবর্তন হলো; কতো জনপদ বিলুপ্ত হয়ে জন্ম হলো নতুন জনপদের, কতো প্রমত্ত নদী ম’রে গিয়ে জন্ম হলো নতুন নদীর, গরুর গাড়ি আর শকট ছেড়ে মানুষ আরোহণ করলো বিমান আর রেলগাড়িতে, কতো গ্রহ-নক্ষত্র আবিষ্কৃত হলো, মানুষ মহাকাশে-চাঁদে গেল, খোঁজ শুরু হলো প্রাণসমৃদ্ধ ভিনগ্রহের, কুপির আলোর পরিবর্তে জ্বললো বিজলি বাতি, কতো মনীষীর জন্ম হলো আর তাদের বিস্ময়কর সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ হলো পৃথিবী; কিন্তু আরবের মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তির খুব বেশি উন্নতি হলো না, তারা অসভ্যই রয়ে গেল; যার অনেকটাই প্রবেশ করেছে অনারব মুসলমানদের মধ্যেও। আইনস্টাইন, নিউটন, চার্লস ব্যাবেজ, জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানভাবনা অতিক্রম ক’রে এরা আরো পিছনে গিয়ে বিজ্ঞান খোঁজে কোরানে; উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, লর্ড বায়রন, পাবলো নেরুদা, জীবননান্দ দাশের কবিতার পংক্তির চেয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা ভাবে কোরানের প্রতিটি আয়াতকে; সক্রেটিস, প্লেটো, হিউম, কাল মার্কসের চেয়েও আরো গভীর মননশীল ও বাস্তববাদী দার্শনিক ভাবে মোহাম্মদকে; লালন, বেটোভেন, মোৎসার্ট, বব মার্লে, রবিশংকরসহ আরো অসংখ্য শিল্পীর সঙ্গীতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত হিসেবে আখ্যা দেয় আজানকে! পৃথিবীর শত শত মনীষীকে পেছনে ফেলে শ্রেষ্ঠ মনীষীর সিংহাসনে বাসায় একজন অসভ্য, উন্মাদ, বর্বর, খুনি, নিপীড়ক, ধর্ষক ও সাম্রাজ্যলোভী পুরুষ মোহাম্মদকে!

আধুনিককালে কাফেরদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় মাটির নিচে তেলের সন্ধান না পেলে আরবদের জীবন হয়তো এখনো রুটি আর খেজুরের ওপরই নির্ভরশীল থাকতো। বাকি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ওরা কাফেরদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণ করলেও গ্রহণ করেনি কাফেরদের সভ্য সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, সুশিক্ষা, শিষ্টাচার, মানবিকতা, মহানুভবতা। ওদের বুদ্ধিবৃত্তি, দর্শন, আদর্শ ও জীবনাচার এখনো আবর্তিত হয় চোদ্দশো বছর আগে জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ এবং তার নাজিল করা গ্রন্থ কোরানকে কেন্দ্র ক’রে। এরা জীবনব্যবস্থার সকল তরিকা খুঁজে পায় কোরান-হাদিসে, এদের কাছে এখনো আদর্শ পুরুষ মানেই হযরত মোহাম্মদ!

গোসল ক’রে বাথরুম থেকে বেরোতেই ক্ষিধেটা চাগাড় দিয়ে উঠলো। এক্স-রের প্রয়োজনে রাতে ম্যাগনেসিয়াম মিল্ক খেতে হয়েছিল, সকালবেলা পুরো পেট খালি হয়ে গেছে। নাস্তা ক’রে চা বানিয়ে নিয়ে এসে বসলাম টেবিলে, কম্পিউটার চালিয়ে তিব্বতিয়ান মেডিটেশন মিউজিক ছেড়ে দিলাম। আসমা বু’র বোনের নির্যাতনের ব্যাপারটা মাথায় ঘাপটি মেরে আছে।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পুরুষের পাশপাশি অনেক নারী শ্রমিকও কাজ করতে যায়। সৌদি আরবের ভাষায় এই শ্রমিকেরা মিসকিন, বাংলাদেশকে তারা ভাবে মিসকিনের দেশ। তাদের ধারণা যে, তারা দয়া ক’রে এদেশ থেকে মিসকিন নেয়, তাদের বাড়িতে-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ ক’রে মিসকিনেরা দেশে যে টাকা পাঠায়, তাই দিয়েই মিসকিনদের আত্মীয়-স্বজনেরা খেয়ে-প’রে কোনোরকমে বেঁচে থাকে। মিসকিনদের দেশে তো তেলের খনি নেই!

নির্বোধ এবং নির্দয় আরবরা মানবাধিকারের তোয়াক্কা না ক’রে তাদের প্রতিষ্ঠানে বা বাড়িতে কর্মরত এইসব শ্রমিকদের ওপর নানা পন্থায় শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন চালায়। সভ্যদেশে অনেক আগেই ক্রীতদাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও কোরানের নির্দেশনা আর মোহাম্মদের জীবনাচার অনুসরণ ক’রে আরবের মুসলিম পুরুষপুঙ্গবরা তাদের বেতনভুক্ত পুরুষ শ্রমিককে ক্রীতদাস আর নারী শ্রমিককে মনে ক’রে যৌনদাসী। ইসলামে একজন মুসলমানকে একসঙ্গে চারজন স্ত্রী রাখার বৈধতা দেওয়া হলেও দাসী রাখার ক্ষেত্রে কোনো সংখ্যা নির্ধারণ ক’রে দেওয়া হয়নি। ফলে একজন পুরুষ বাড়িতে অসংখ্য দাসী রাখতে পারে, অধিকার বা মালিকানার ভিত্তিতে দাসীদের সঙ্গে যৌনসঙ্গম করতে পারে। মোহাম্মদের অনেক দাসী ছিল; যাদের মধ্যে অতি সুন্দরী কয়েকজনকে তিনি বিয়ে ক’রে উপপত্নীর মর্যাদা দিয়েছিলেন!

মোহাম্মদ এবং তার বাহিনী বানু আল-মুসতালিক গোত্রের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেছিলেন; আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধীকারীদের হত্যার পর কিছু সংখ্যক বন্দী পুরুষকে ক্রীতদাস এবং লুণ্ঠিত সম্পদ, নারী ও শিশুদেরকে গনিমতের মাল হিসেবে নিজেদের মধ্যে ভাগ ক’রে নিয়েছিলেন। জুয়ায়রিয়া বিনতে আল হারিথ ছিলেন বানু আল-মুসতালিক গোত্র প্রধান আল-হারিস বিন আবু দেরার এর কন্যা এবং মুসাফির বিন সাফওয়ানের স্ত্রী; গনিমতের মাল হিসেবে তিনি একজন মুসলমান যোদ্ধার ভাগে পড়েছিলেন, যিনি উচ্চ মুক্তিপণের বিনিময়ে তাঁকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অতোটা মুক্তিপণ দেবার সাধ্য জুয়ায়রিয়ার ছিল না; তাই সে মোহাম্মদের শ্মরণাপন্ন হয়েছিলেন যাতে তার মালিককে ব’লে মোহাম্মদ মুক্তপাণের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দেন। তিনি যখন মোহাম্মদের বাড়িতে যান, তখন মোহাম্মদের প্রিয় স্ত্রী আয়েশা তাকে দেখামাত্র বিচলিত হয়ে পড়েন, কেননা তিনি ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দরী। আয়েশা আশঙ্কা করেছিলেন যে, আল্লার নবী এই নারীর সৌন্দর্য দেখলে মুগ্ধ হবেন এবং তাকে স্ত্রী হিসেবে পেতে চাইবেন। হয়েছিলও তাই, জুয়ায়রিয়া যখন মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা ক’রে তার মুক্তিপণ কমানোর অনুরোধ করলেন, তখন মোহাম্মদ তাকে জানালেন, ‘আমি তোমার জন্য এর চেয়ে ভাল কিছু করবো। তোমার মুক্তিপণ রদ ক’রে তোমাকে বিয়ে করবো।’

ক্রীতদাসী জুয়ায়রিয়ার হাতে এর চেয়ে ভাল কোনো বিকল্প না থাকায় তিনি মোহাম্মদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন, আর মোহাম্মদ তাকে উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

সাফিয়া বিনতে হুয়েই বিন আখতাব; তিনি ছিলেন খায়বারের বানু নাদির গোত্রের ইহুদি নেতা কেনানা বিন আবু রাবিয়ার সতেরো বছর বয়সী সুন্দরী স্ত্রী। পূর্বে বানু নাদির গোত্রের বসতি ছিল মদিনায়, মোহাম্মদ তাদেরকে মদিনা থেকে উৎখাত করেন ৬২৫ সালে। খায়বারেও কয়েকবার ছোটো-খাটো অভিযানের পর ৬২৮ সালে ষোলশো জিহাদী নিয়ে মোহাম্মদ নিজে খায়বার আক্রমণ করেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইহুদিরা পরাজিত হয়। বানু নাদিরের দলনেতা কেনানার বুকে আগুন রেখে নির্যাতন করার পর তাকে হত্যা করা হয়। ইহুদি যোদ্ধাদের হত্যার পর তাদের নারী এবং শিশুদেরকে গনিমতের মাল হিসেবে জিহাদীদের মধ্যে ভাগ ক’রে দেওয়া হয়। জিহাদী দিহাইয়া বিন খলিফা আল-কালবি’র ভাগে পড়েছিলেন কেনানার স্ত্রী সাফিয়া। কিন্তু অনিন্দ্য সুন্দরী কিশোরী সাফিয়ার সৌন্দর্য অবলোকন ক’রে দিহাইয়ার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়েই হোক বা যে কারণেই হোক অপর এক জিহাদী মোহাম্মদের কাছে গিয়ে সাফিয়ার রূপের প্রশংসা ক’রে ব’লে, ‘বন্দীদের মধ্যে এমন সুন্দরী আর কাউকে দেখিনি, আল্লাহ্’র নবী-ই কেবলমাত্র তার যোগ্য হতে পারেন!’

সাফিয়ার রূপের প্রশংসা শুনে বিচলিত মোহাম্মদ তৎক্ষণাৎ দিহাইয়া এবং সাফিয়াকে তার নিকট নিয়ে আসার আদেশ করেন। সুন্দরী সাফিয়াকে দেখার পর তার রূপে মুগ্ধ হন মোহাম্মদ। তিনি দিহাইয়াকে বঞ্চিত ক’রে সাফিয়াকে নিজের জন্য মনোনীত করেন, সাফিয়াকে তার পেছনে অবস্থান নিতে বলেন এবং নিজের গায়ের আলখাল্লা জড়িয়ে দেন সাফিয়ার গায়ে যাতে তার অনুসারীরা বুঝতে পারে যে, সাফিয়া তার মনোনীত দাসী। এরপর তিনি দিহাইয়াকে নির্দেশ দেন অন্যান্য বন্দী দাসীদের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নিতে। নবীর বাসনার কাছে নিজের বাসনা বিসর্জন দিয়ে বঞ্চিত দিহাইয়া সাফিয়ার দু’জন চাচাতো বোনকে গ্রহণ করে।

মোহাম্মদ সেই রাতেই নিজের তাঁবুতে সাফিয়ার সঙ্গে রাত্রিযাপন করেন। আবু আয়ুব নামে এক জিহাদী তার প্রিয় রাসুলের জন্য দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল এজন্য যে, তার রাসুল সাফিয়ার স্বামী, বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে হত্যা করেছেন, আবার তার সঙ্গে একই তাঁবুতে রাত্রিযাপন করছেন, সাফিয়া যদি ঘুমন্ত রাসুলের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে! তাই সারারাত তাঁবুর বাইরে পাহারায় ছিল সে, যা মোহাম্মদ জানতেনও না। পরবর্তীতে খায়বার থেকে মদিনায় ফেরার পর মোহাম্মদ সাফিয়াকে বিয়ে করেন।

রায়হানা - বানু কোরায়জা গোত্রের সুন্দরী নারী। বানু কোরায়জা গোত্রের ওপর গণহত্যা চালানোর পর মোহাম্মদ গনিমতের মাল হিসেবে রায়হানাকে হস্তগত করেছিলেন এবং ওই রাতেই তিনি রায়হানার সঙ্গে যৌনসঙ্গম করেছিলেন। নিজের স্বজন এবং জ্ঞাতিদের হত্যার কারণে মোহাম্মদের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা থাকায় সে ইসলাম গ্রহণ এবং মোহাম্মদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। যৌনদাসী হিসেবেই সে মোহাম্মদের বাড়িতে ছিল।

মারিয়া আল-কিবতিয়া; মিশরের কপটিক খ্রিষ্টান সুন্দরী নারী। মিশরের রোমান শাসক আল-মুকাওকিস (ইসলামের ইতিহাসে মিশরের শাসকদের আল-মুকাওকিস বলা হয়) মোহম্মদের কাছ থেকে হুমকিপত্র পাওয়ার পর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকে খুশি করার জন্য খচ্চর, গাধা, মূল্যবান পোশাক এবং অন্যান্য উপহার সামগ্রীর সঙ্গে মাবুর নামে একজন নপুশংক দাস এবং মারিয়া ও তার বোন শিরীনকে দাসী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। মোহাম্মদ এই উপহার গ্রহণ করেছিলেন; তার অনুসারী হাসান বিন তাবিথের কাছে তিনি উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছিলেন শিরীনকে, আর মারিয়াকে রেখেছিলেন নিজের জন্য। বলা হয়ে থাকে যে, মারিয়ার গর্ভে ইব্রাহিম নামে মোহাম্মদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিল, জন্মের আঠারো মাসের মাথায় যার মৃত্যু হয়।

বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধজয়ের পর মোহাম্মদ গনিমতের মাল হিসেবে নিজের হিস্যাপ্রাপ্ত দাসীদের সঙ্গে যৌনসঙ্গম করতেন, তার অনুসারীদের বঞ্চিত ক’রে সুন্দরী দাসীদেরকে যেমনি নিজের জন্য নির্বাচন করতেন, তেমনি কখনো কখনো নিজের ভাগের অপেক্ষাকৃত কম সুন্দরী দাসীদেরকে উপহার স্বরূপ বন্টন করতেন তার প্রিয় অনুসারীদের মধ্যে।

মোহাম্মদের যৌনজীবন আজও আরবের পুরুষদেরকে অনুপ্রাণিত করে। তারা তাদের প্রিয় নবীকে অনুসরণ ক’রে নিজেদের হেরেমে অসংখ্য স্ত্রী এবং যৌনদাসী রাখে। মোহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা সাধারণত বিধর্মী নারীদেরকে ইসলামে দীক্ষিত ক’রে তাদেরকে যৌনদাসী করতেন, কিন্তু বর্তমানের আরবপুরুষরা যাদেরকে যৌনদাসী ভেবে নিপীড়ন করে, তারা বংশ পরম্পরায় অনেক আগে থেকেই মুসলমান। তারপরও তারা এদের ওপর যৌননির্যাতন চালায়। অথচ ইসলাম নাকি ভ্রাতৃত্বের কথা বলে, নিজের উম্মতের নারীদের রক্ষার কথা বলে!

বাংলাদেশ থেকে যেসব নারী আরব দেশগুলোতে কাজ করতে যায়, তারা সাধারণত গ্রামের দরিদ্র নারী, তারা যায় বাসা বাড়িতে কাজ ক’রে নিজের পরিবারে একটু স্বচ্ছলতা আনার জন্য। আরবের মুসলমান সংস্কৃতি এবং মানুষের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে এরা অবগত নয়। তাছাড়া প্রিয় নবীর দেশের সবই এদের কাছে পবিত্র মনে হয়, সেই পবিত্র দেশের মানুষের দর্শনলাভ এবং পবিত্র দেশের মাটি-পানি-বাতাসের স্পর্শ পাবার স্বপ্নও এদের অন্তরে থাকে। কিন্তু টাকা-পয়সা খরচ ক’রে নবীর দেশে পা দেবার কিছুদিনের মধ্যেই নবীর পবিত্র দেশ সম্পর্কে এদের ঘোর কাটে। এরা নবীর দেশে গৃহকর্ম করার উদ্দেশে গেলেও অধিকাংশ-ই নবীর দেশের পবিত্র পুরুষের সঙ্গে যৌনকর্ম করতে বাধ্য হয়। পিতা-পুত্র, চাচা-ভাতজা, দাদা-নাতিসহ পরিবারের সকল পুরুষই একই নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হবার ঘটনাও ঘটে; যৌনকর্মে বাধা দিলে জোটে অমানুষিক প্রহার! লোহার রড কিংবা খুন্তি পুড়িয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছেঁকা দেওয়া আরবদের কাছে অতি স্বাভাবিক শাস্তি; আর চুলের মুঠি ধরে কিল-ঘুষি, লাথি, বেত্রাঘাত এসব তো নিতান্তই মামুলি ব্যাপার, প্রায় রোজই এক-আধবার জোটে! শাস্তি প্রদানে আরবদের গিন্নীরাও কম সিদ্ধহস্ত নয়, এমনিতেই গিন্নীদের রাগ থাকে এইসব কাজের মেয়েদের ওপর, কেননা এরা দাসী হয়েও যে তাদের পুরুষদের আদর-সোহাগের ভাগ পায়; ফলে পান থেকে চুন খসলেই তারা দাসীদের ওপর খাঁড়া ধরে!

অভাবের সংসারের টাকা-পয়সা খরচ ক’রে যাওয়ায় বেশিরভাগ নারীই দেশে রেখে যাওয়া বাবা-মা, স্বামী-সন্তানের কথা চিন্তুা ক’রে এই অত্যাচার মেনে নেয়। অনেকে পালাবার পথ খোঁজে, কেউ পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নেয়, কেউবা বাংলাদেশে স্বজনদের ফোন ক’রে কান্নাকাটি করে তাকে দেশে ফিরিয়ে নেবার জন্য। আজকাল অনেকেই ফিরে আসছে দেহ-মনে নবীর দেশের পবিত্র মানুষের নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে।

এতো যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, কিছু কিছু মিডিয়াতেও আসছে; তারপরও না সাধারণ মানুষ সচেতন হচ্ছে, না সরকার আরব দেশগুলোতে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করছে। আরব দেশগুলোতে নারী শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে, তাই দেশগুলোর দাবি অনুযায়ী সুসম্পর্ক বজায় রাখার খাতিরে বাংলাদেশ সরকার নিজের দেশের মা-বোনদের জীবন বিপন্ন ক’রে তাদেরকে সেখানে পাঠাচ্ছে। তাছাড়া নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে বলেও সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা এই বিষয়ে সাফাই গাইছে এই বলে যে, বিদেশে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ ক’রে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন শক্তিশালী হবে ব’লে নারীদেরকে যৌনদাসত্বের মুখে ঠেলে দিতে হবে! নাকি বঙ্গবন্ধুর অজস্র স্বপ্নের মধ্যে এই স্বপ্নও ছিল যে, তাঁর দেশের দরিদ্র নারীরা অর্থের বিনিময়ে প্রিয় নবীর দেশের পুরুষদেরকে যৌনসেবা করবে? তা ভাল বলতে পারবে তাঁর প্রধানমন্ত্রী কন্যা!

(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন