আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৭

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ২৮)

লিখেছেন উজান কৌরাগ


আধো ঘুমের মাঝেই উপলব্ধি করলাম বাস ক্রমশ ওপর দিকে উঠছে। চোখ খুলে জানালার বাইরে দৃষ্টি ছুড়ে দিতেই দেখি প্রেয়সীর চুলের মতো ঘন গাছপালা, গ্রীবার মতো আদুরে আলো-ছায়াময় শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতি! অরণ্যের ভেতর দিয়ে মৃত অ্যানাকোন্ডার মতো একে-বেঁকে প'ড়ে আছে কালো পিচের রাস্তা, আর বড় আকৃতির পিঁপড়ার মতো তার গা বেয়ে চলেছে বাসটি। বান্দরবান শহরের খুব কাছেই চ'লে এসেছি আমরা, সাত-আট মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব বাসস্ট্যান্ডে। আমার পাশের সিটে আবির ঘুমোচ্ছে, ওকে জাগালাম। সামনের সিটে বসেছে শাশ্বতীদি আর পরাগদা; ওরা আগেই জেগেছে, তাকিয়ে আছে জানালার বাইরের সবুজে। বাসের যাত্রীরা একে একে জেগে উঠছে। পেছন দিকের কেউ একজন মোবাইলে গান চালিয়েছে - 'লাল পাহাড়ের দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা'। 

বাস থেকে নেমে অটোয় চেপে গেলাম উংক্ষ্যংছড়িগামী বাসের কাছে। বাস ছাড়ার আগে টয়লেট সেরে, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা ক'রে নিলাম। মিনিট চল্লিশের মধ্যে সিট পূর্ণ হলে গজরাতে গজরাতে পাহাড়ী পথে চলতে শুরু করলো বাস। শুরু হলো রোমাঞ্চকর যাত্রা। কোথাও পাহাড়ের কোল ঘেঁষা রাস্তা, কোথাওবা রাস্তা থেকে পাহাড় অনেক নিচে। রাস্তার বাঁকগুলো ঘোরার সময় বা কোথাও খারাপ রাস্তার কারণে বাস যখন কাত হয়, তখন নিচের দিকে তাকালে বুকের ভেতর শিরশির ক'রে একটা বেতাল হাওয়া ব'য়ে যায়! তবে বেতাল হাওয়ায় বেশি মনোযোগ না দিয়ে পাহাড়ের কোলে আটকে থাকা দুধের নদীর মতো সাদা মেঘমালা উপভোগ করাই শ্রেয়। কোথাও রাস্তার ওপরেই আছে টুকরো টুকরো মেঘ, ঘাতকের মতো মেঘের বুক চিরে ধাবিত হচ্ছে বাস। জানালা খোলা থাকায় আমাদেরও হচ্ছে মেঘের সাথে আলিঙ্গন, মধুর চুমোচুমি! 

বাস থেকে উংক্ষ্যংছড়িতে নেমে উঠলাম সাঙ্গু নদীর ঘাটে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা ট্রলারে। আমরা চারজন ব্যতিত আর পাঁচজন পর্যটক উঠলো ট্রলারে, বাকিরা স্থানীয় আদিবাসী। ঘাট ছাড়ার আগ মুহূর্তে এক বৃদ্ধা দূর থেকে হাত দিয়ে ইশারা করায় তার জন্য অপেক্ষা করলো ট্রলার। বৃদ্ধার ঊর্ধ্বাঙ্গে ব্লাউজ আর নিম্নাঙ্গে লুঙ্গি, পায়ে বার্মিজ স্যান্ডেল, মাথার কাঁচা-পাকা চুল পেছন দিকে খোঁপা করা, পিঠে পাহাড়ী টুকরি, মুখে কালো রঙের পাইপ; দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে ট্রলারে উঠে টুকরিটা সামনে রেখে পাটাতনে বসলেন। ট্রলার ঘাট ছাড়লো। বৃদ্ধা আয়েশ ক'রে পাইপ টেনে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন। ট্রলারে এতোগুলো পুরুষ রয়েছে, সেদিকে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, পারের দিকে তাকিয়ে আপন মনে পাইপ টানছেন। মনে মনে এই বৃদ্ধার সঙ্গে আমার দাদীর তুলনা করতে গিয়ে নিজেকে কেমন বোকা মনে হলো! এই বৃদ্ধা হয়তো লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু লেখাপড়া জানা অনেক বাঙালি নারীর চেয়ে তিনি স্বাধীন, স্বতন্ত্র, ব্যক্তিত্ববান। আমরা বাঙালিরা নাকি সভ্য-আধুনিক। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষিত পুরুষও নারীদেরকে গৃহবন্দী ক'রে রাখতে পছন্দ করে। মওলানাদের কথা আর নাইবা বললাম। অধিকাংশ শিক্ষিত নারীকেই পুরুষের গঞ্জনা সইতে হয়। আমরা, তথাকথিত সভ্য সমাজের মানুষেরা, আজও নারীকে যে সম্মান দিতে পারিনি, অনেক বাঙালির ভাষায় বন্য-জংলি আদিবাসীরা তাদের নারীদের তার চেয়েও অধিক সম্মান দিয়েছে। অনেক আদিবাসী সমাজই মাতৃতান্ত্রিক। আমাদের তথাকথিত সভ্যতা-আধুনিকতা বন্য আদিবাসীদের সামনে মাথা হেঁট ক'রে থাকে লজ্জায়! আমরা হয়তো অনেকেই তা বুঝি, আর অধিকাংশ মানুষই বুঝি না।

বৃদ্ধার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি দৃষ্টি এবং মন দিলাম সাঙ্গুর দু'পারের প্রকৃতিতে। দু'পাশে সবুজ অরণ্য, মাঝে মাঝে ছবির মতো ঘর-বাড়ি, কোথাও জুমচাষে ব্যস্ত কৃষক। জীবনে পদ্মা-মেঘনা-যমুনাসহ অনেক বড় বড় নদী দেখেছি, নৌ-ভ্রমণ করেছি; সেসব নদী এবং নদী পারের আলাদা সৌন্দর্য আছে; তবে সাঙ্গু আর তার দু'পারের কাছে সেসব নদী আর নদীপারের জনপদ যেন অনেকটাই স্লান! আমি বান্দরবান থেকে ট্রলারে আটঘন্টাব্যাপী থানচিতে গিয়েছি। কিন্তু সাঙ্গু আর দু'পারের মানুষ-প্রকৃতি কখনোই আমাকে ক্লান্ত করেনি, বরং উজ্জ্বীবিত করেছে। শাশ্বতীদির ক্যামেরা পর পর ক্লিক করছে, ধারণ করছে নদীপারের দৃশ্য।

রুমা বাজার পৌঁছে প্রথমেই একটা আদিবাসী হোটেলে ঢুকলাম। ওদেরকে ভাত খেতে ব'লে আমি ছুটলাম গাইড খুঁজতে। খাওয়ার পর গেলে গাইড পাব না তা নয়, আজ ঈদের পূর্বদিন হওয়ায় পর্যটকের খুব বেশি চাপ নেই। পর্যটকের চাপ বাড়বে ঈদের পরদিন থেকে। তারপরও ছুটলাম এ জন্য যে, যদি আমাদের পূর্ব পরিচিত নরখেলেই্ম দাদাকে পাই, তো ভাল হয়। গলি পেরিয়ে এগোতেই আমাকে দেখে কয়েকজন গাইড এগিয়ে এলো, এর মধ্যে একজন শফিকুল। শফিকুল সালাম দিয়ে বললো, 'ভাই, আমারে চিনছেন?'

আমি মৃদু হেসে বললাম, 'হুম।'

'ভাই, গাইড লাগতো?'

'হুম।' 

'আমি যাইতাম।'

'আবার! তোমারে তো ভাই ঘাড়ে ক'রে আনতে পারবো না!'

শফিকুলের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একজন আদিবাসী গাইডের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, 'নরখেলেই্মদাকে কোথায় পাব, বলতে পারেন?'

'নরখেলেই্ম? ওই সামনের গলিতে একটা পানের দোকান, ওকানে দেখিছি একটু আগে।' 

'থ্যাঙ্ক ইউ।' আমি পা বাড়ালাম। 

শফিকুলকে গাইড হিসেবে নিয়ে সেবার আমাদের চরম শিক্ষা হয়েছে। মহা অলস, হেঁটে আমাদের চেয়েও পেছনে পড়ে। সেবার কেওক্রাডাং থেকে জাদিপাই যাব, দুপুুর গড়িয়ে গেছে, গিয়ে আবার ফিরতে হবে। তো সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা জাদিপাই থেকে ফিরে একবারে ফ্রেশ হয়ে ভাত খাব। ও জানালো, ভাত না খেয়ে এক পা-ও যেতে পারবে না। ও ভাত খেলো আর আমরা ব'সে ওর জন্য অপেক্ষা করলাম। ফেরার পথে জানালো, 'ভাত না খাইলে আমারে ঘাড়ে ক'রে নেওয়া লাগতো আপনাগো।' খাওয়ার ব্যাপারটি আমরা ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি, বেচারার ক্ষুধা পেলে তো খাবেই। কিন্তু সমস্যা হলো, ও একে তো অলস, তার ওপর একটুও আন্তরিকতা নেই। লাঠি কিংবা প্রয়োজনীয় কিছু দরকার হ'লে ওকে ঠেলে পাঠাতে হয়। ভাবখানা এমন যে, আমি তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এই তো তোমাদের পরম সৌভাগ্য! ফেরার সময় আবার চাঁদের গাড়ির ভাড়া নিয়ে ঝামেলা পাকিয়েছিল। চরম শিক্ষা হয়েছিল সেবার। এরপরই সিদ্ধান্ত নিই, আর কোনোদিন বাঙালি গাইড নেব না। সব বাঙালি গাইডই যে অপেশাদার, তা নিশ্চয় নয়, কিন্তু সর্বক্ষেত্রে বাঙালির অপেশাদার আচরণ দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত-বিরক্ত; ফলে উত্তম বিকল্প যেহেতু আছে, ঝুঁকি এড়ানোই শ্রেয়! 

যথাস্থানে নরখেলেই্মদা'কে পেয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই একগাল হেসে এগিয়ে এলো, 'বালো আচেন দাদা?'

'হ্যাঁ, তুমি কেমন আছো নরখেলেই্মদা।'

'বালো।'

'জাদিপাই যাব, তুমি ফ্রি আছো তো?'

'হা, ফ্রি আচি। কিন্তু জাদিপাই তো যেতে দেবে না।'

'কেন?' 

'নিরাপত্তার কারণে আর্মি ওদিকে যেতে দিচ্ছে না।' 

ইস্! কতো আগ্রহ নিয়ে এসেছি যে, জাদিপাই যাব! যদিও এর আগে বর্ষায় ভরা যৌবনবতী জাদিপাই ঝর্ণাকে দেখেছি, অবগাহন করেছি ঝর্ণার জলে। তবু আফসোস হচ্ছে, কেননা জাদিপাই ঝর্ণার সৌন্দর্য এমন মনোমুগ্ধকর যে, সেখানে হাজারবার যেতেও আমি রাজি! 

নরখেলেই্মদাকে নিয়ে আবার হোটেলে ফিরলাম। ওরা খাবারের অর্ডার দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নরখেলেই্মদাকে দেখে ওরাও খুশি হলো। হাত-মুখ ধুয়ে এসে আমি আর নরখেলেই্মদা-ও ব'সে পড়লাম টেবিলে বসলাম। অর্ডার মতো টেবিলে এলো ভাত, আলু ভর্তা, শুটকি ভর্তা, ডাল আর মুরগির মাংস। পরাগদা গরুর মাংস খেতে চাইলে শাশ্বতীদি চোখ রাঙিয়ে আদুরে ধমক দিলো। পরাগদা গরুর মাংস খায়, কিন্তু শাশ্বতীদি সাথে থাকলে তাকে গরুর মাংস খেতে দেয় না, ওদের বাসাতেও গরুর মাংস নিষিদ্ধ করেছে শাশ্বতীদি। কোনো সংস্কার থেকে নয়, শাশ্বতী এটা ক'রে কারণ ভবিষ্যতে কোনোদিন যাতে তার শ্বশুরবাড়ির মানুষ বলতে না পারে যে, মুসলমান বউ তাদের ছেলেকে গরুর মাংস খাওয়া শিখিয়েছে। 

হোটেলটা খুব পরিচ্ছন্ন, আদিবাসীদের হোটেল। গাইডের ক্ষেত্রে যেমনি আমরা বাঙালি গাইড বর্জন করেছি, তেমনি পাহাড়ে এসে সর্বক্ষেত্রেই আমরা বাঙালিদের চেয়ে পাহাড়ীদের প্রাধান্য দিই। বলা যায়, বাঙালি হয়েও পাহাড়ে এসে আমরা বাঙালিদের সংস্পর্শ যতোটা পারি এড়িয়ে চলি। এর কারণ আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা। বান্দরবানে একবার একটা বাঙালি হোটেলে খেতে ব'সে ঝোলের ভেতর তেলাপোকা পেয়েছিলাম। একবার থানচিতে পৌঁছেছিলাম বড় অবেলায়, তাই বাধ্য হয়ে আমাদের একটা বাঙালি হোটেলে খেতে হয়েছিল। ভীষণ নোংরা হোটেল; থালা-গ্লাস, জগ, টেবিল সমস্ত নোংরা। নোংরা পরিবেশের কারণে পেট পুরে খেতেও পারিনি, রাতেরবেলা এক আদিবাসী হোটেলে খেয়েছিলাম তৃপ্তি ক'রে। আরেকবার রুটির মধ্যে বেশ বড় একটা চুল পেয়েছিলাম। চুল না হয়ে বাল হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই; কেননা বাঙালি হোটেলের অধিকাংশ ময়রা আটা মাখা, গোল্লা বানানো আর বেলনার ফাঁকে ফাঁকেই অণ্ডকোষ কি পাছা চুলকায়; হাত না ধুয়ে ওভাবেই পুনরায় কাজ শুরু করে! বাঙালী হোটেলের অপরিচ্ছন্নতার নমুনা আমাদের শহরগুলোর অলিগলিতে পাওয়া যায়। অনেকবারের পাহাড়ী অভিযানে, আদিবাসীদের জীবনযাপন অবলোকন ক’রে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, বাঙালীদের চেয়ে আদিবাসীরা অধিক সৎ, সভ্য, এবং পরিচ্ছন্ন জাতি। আমি যখন এই কথাগুলো আমার বন্ধুদের কাছে বলি, তখন অনেক বন্ধু রেগে যায়; বলে, 'যা, তুই একটা খাসিয়া-খুসিয়া বিয়ে ক'রে পাহাড়েই থাক গিয়ে!'

অথচ আমি অযৌক্তিক বা মিথ্যা কিছু বলিনি। আমাদের শহরগুলোর রাস্তাঘাটের দিকে, নদী-নালার দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, বাঙালীরা কতোটা নোংরা। আমাদের সমতলের হাজার হাজার বাঙালী গ্রাম ঘুরেও আদিবাসীদের গ্রামের মতো পরিচ্ছন্ন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং আদিবাসীদের এই গ্রামগুলো যতোটুকু নোংরা করার আমরা বাঙালিরা ঘুরতে এসে করি; যত্রতত্র চকলেট, চিপস, সিগারেটের প্যাকেট, কলার খোসা ইত্যাদি ফেলি; আর ওরা সেসব পরিষ্কার করে। আদিবাসীদের বেশিরভাগ ঘর কিংবা দোকানের সামনেই ময়লার ঝুড়ি থাকে, তারপরও বাঙালী পর্যটকরা যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে। আর যে পথ দিয়ে পর্যটকরা হেঁটে যায়, পথের মাঝে নানান রকম পণ্যের মোড়ক ফেলতে ফেলতে যায়। 

আদিবাসীরা অনেক সৎ; যত্রতত্র জিনিষ ফেলে রাখলেও ওরা কখনো কারো জিনিসে হাত দেয় না। এতোবার পাহাড়ে এসেছি কিন্তু কোনোদিন আমাদের কোনো জিনিস হারায়নি, শুধু একবার আমার একটা টি-শার্ট ছাড়া। আর এই টি-শার্টটাও কোনো পাহাড়ী চুরি করেনি, চুরি করেছিল শহর থেকে অবকাশ যাপনে আসা তথাকথিত সভ্য কোনো বাঙালি পর্যটক। এক বিকেলে ঘাটের কাছে প্যান্ট আর টি-শার্ট রেখে বগা লেকে গোসল করছি, সেখানে আরো পনের-বিশজন বাঙালী পর্যটক, কেউ গোসল করছে কেউবা গোসল সেরে উঠছে, কোনো আদিবাসী নেই। ট্রেকিংয়ের ক্লান্তি বগা লেকে ধুয়ে ফুরফুরে দেহ-মনে ওপরে উঠে দেখি, আমার টি-শার্ট হাওয়া! ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আর বাঙালি তীর্থে কি পর্যটনে গেলেও চুরি করে। 

খেতে খেতে আমাদের পাশের টেবিলের চোদ্দ-পনের বছর বয়সী এক আদিবাসী কিশোরের দিকে আমার নজর পড়লো। ছেলেটা বাঁ-হাতি, বাঁ-হাত দিয়ে যত্ন ক'রে ভাত মেখে খাচ্ছে। কোনো ছন্দপতন নেই, কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, একদম সহজাত। অথচ মুহাম্মদ, বলেছে ডানহাতে খেতে এবং ডানদিক থেকে সব কাজ শুরু করতে! যে জন্মগত বাঁ-হাতি, সে ডানহাতে খাবে কী ক'রে! একজন বাঁ-হাতিকে ডান হাত দিয়ে খেতে বলা কিংবা জোর ক'রে ডান হাত দিয়ে খেতে শেখানো তো প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ। দেশ যেদিকে এগোচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বাঁ-হাত দিয়ে খাবার জন্য বাঁ-হাতিদেরও চাপাতির কোপ খেতে হতে পারে! 

খাওয়ার পর ট্রেকিং-এর জন্য প্লাস্টিকের স্যান্ডেল কিনলাম সবাই। চারটে ব্যাগ দুটো করলাম, মানে চারজনের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস দুটোয় ঢুকিয়ে নিলাম আর বাকি জিনিস অন্য দুটোয় ঢুকিয়ে নরখেলেই্মদার পরিচিত এক দোকানে রেখে এলাম। তারপর ক্যাম্পে গিয়ে নাম এন্ট্রি ক'রে উঠলাম চাঁদের গাড়িতে, আমরা ছাড়াও স্থানীয় আরো দু'জন উঠলো চাঁদের গাড়িতে। 

চাঁদের গাড়ির যাত্রা ভীষণ রোমাঞ্চকর, মাঝে মাঝে মনে হয় রোলার কোস্টারে চড়েছি; কখনো ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নামছে তো নামছেই, আবার কখনো ষাট-সত্তর ডিগ্রি খাড়া ঢাল বেয়ে উঠছে তো উঠছেই! অতিরিক্ত খাড়া ঢালগুলো ওঠার সময় পেছন দিকে তাকালে মনে হয় এই বুঝি গাড়ি উল্টে যাবে। ঢালগুলোয় ওঠার সময় মাঝে মাঝে আমরা সবাই সমস্বরে 'ও' ব'লে চিৎকার করে উঠছি, শাশ্বতীদি একেকবার আমাদের একেকজনের হাত নয়তো হাঁটু খাঁমচে ধরছে। ধার্মিকেরা বলে প্রাণের মালিক আল্লাহ্ বা ভগবান, আমি বলি - প্রাণের মালিক আমি; তবে এই পাহাড়ী পথে প্রাণের মালিক চাঁদের গাড়ির চালক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একটু এদিক-ওদিক হলেই এক-দেড়শো ফুট নিচের গাছপালায় কি পাথরে আছড়ে পড়বো। তবে এ পথের চালকেরা খুবই দক্ষ। 

পথের পাশের একটা পাড়ায় স্থানীয় একজন নেমে গেল, এখানেই তার বাড়ি। একের পর এক পাহাড় আর অরণ্য পেরিয়ে আমরা চলেছি সামনের দিকে। রাস্তায় বাঁকে একটা জায়গা খুব খারাপ, ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দিয়ে খালি গাড়ি নিয়ে জায়গাটা পার হলো। এই ফাঁকে জলবিয়োগের জন্য আমি গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। অরণ্যের ঝোপঝাড়-লতাগুল্মের দারুণ একটা বিশুদ্ধ গন্ধ এসে লাগলো নাকে। আমার দেখাদেখি আবির আর পরাগদাও এলো। শাশ্বতীদি দূরে দাঁড়িয়ে দুষ্টুমি ক'রে বললো, 'দাঁড়া, ছবি তুলবো!'

আমাদের ছবি আর তুললো না, এই অবসরে সে তুলতে লাগলো প্রকৃতির ছবি। জলবিয়োগ সেরে আবার গিয়ে উঠলাম গাড়িতে। শৈরাতং পাড়ার কাছাকাছি এসে ঢাল বেয়ে নামার সময় পরাগদা নরখেলেই্মদাকে বললো, 'দাদা, ড্রাইভারকে বলো, আমরা এই পাড়ায় একটু থেমে চা খেয়ে যাই।' 

কথামতো শৈরাতং পাড়ার চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামালো ড্রাইভার। নেমে সবাই বিস্কুট আর কলা খেলাম, পাহাড়ী কলা দারুণ সুস্বাদু, তার ওপর ফরমালিনমুক্ত। খেয়ে ফেললাম হালি খানেক। তারপর চা-টা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম শৈরাতং পাড়ার ভেতরের দিকে, দারুণ পরিচ্ছন্ন আর সুন্দর পাড়াটা। রাস্তার পাশের দোকান আর কয়েকটি ঘর মাটিতে হলেও, পাড়ার ভেতরের দিকের ঘরগুলো বাঁশ আর কাঠের খুঁটির ওপর, মাটি থেকে চার-পাঁচ ফুট উঁচুতে। কাঠের মেঝে, বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া, চালে ছন। দু'জন লোক পিঠে দুটো ভারি বোঝা ব'য়ে নিচের দিক থেকে ওপর দিকে উঠছে। নারীরা নিজেদের মতো কাজ করছে, বাচ্চারা আপনমনে খেলছে। এরা বম সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের বাঙালিদের মতো অতি কৌতূহলী নয়; বাঙালিরা নিজেদের গ্রামে অপরিচিত কাউকে দেখলে নাম, ঠিকানা, কার বাড়িতে এসেছে ইত্যাদির পরও একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে অযাচিত প্রশ্ন করতেও ছাড়ে না; অনধিকার চর্চা বাঙালির মজ্জাগত! কিন্তু এরা তা নয়, এরা নিজেদের মতো কাজ করে, পর্যটকদের প্রতি বিশেষ কৌতূহল নেই, কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয়, ছবি তুলতে চাইলে একটু দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকায় কিংবা হাসে।

আকাশে মেঘের অবস্থা এখন-তখন, ড্রাইভারের তাড়া পেয়ে আবার এসে গাড়িতে উঠতে হলো। রুমা থেকে যখন চাঁদের গাড়িতে উঠলাম, তখনো আকাশ বেশ পরিষ্কার ছিল, ছিল ঝলমলে রোদ্দুর। এটুকু আসতে আসতেই রূপ বদলে গেছে আকাশের, বৃষ্টি হবে - কোনো সন্দেহ নেই। 

দু-পাশে ঋষির মতো মৌনী-ধ্যানি পাহাড়, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে জমাট মেঘ। একটা সুইচ্চ পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে পথের বাঁকে এসে থামলো গাড়ি। পথ সামনে আরো এগিয়ে গেছে, কিন্তু আমরা ওদিক দিয়ে যাব না, ওদিক দিয়ে গেলে খাড়া পাহাড় বেয়ে অনেকটা পথ উঠতে হয়। পরিশ্রম হয় খুব, আবার ঝুঁকিপূর্ণও। একবার ও পথে গিয়েছিলাম, যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছিল। এখান থেকে আমরা বাঁ-দিক দিয়ে নেমে অদূরের ঝিরিপথ দিয়ে যাব, ঝিরিপথ চ'লে গেছে বগালেকের কাছ দিয়ে। ওখান থেকে খাড়া পাহাড় বেয়ে অল্প একটু পথ।

আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। ব্যাগ একটা আমার কাঁধে, আরেকটা নিলো আবির। নরখেলেই্মদা পাঁচটা চিকন বাঁশের লাঠি কেটে এনে চারটে আমাদের হাতে দিলো, আরেকটা রাখলো নিজে। রাস্তা থেকে নেমে সরু পথ দিয়ে আগে আগে হাঁটতে শুরু করলো নরখেলেই্মদা, আমরা পিছে পিছে; সকলের পেছনে আমি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, পরাগদা আবিরকে বললো, 'পলিথিনগুলো ব্যাগে ঢুকিয়েছিলি?'

'হ্যাঁ।' জানালো আবির।

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বালিকা ছিল, ঝিরিতে নামতে নামতে হঠাৎ-ই যেন কৈশোর টপকে যুবতী হয়ে গেল। চটজলদি ব্যাগ থেকে পলিথিন বের ক'রে ছোট একটা পলিথিনের ভেতর সবার মোবাইল-মানিব্যাগ আর আমার ক্যামেরাটা রেখে ঢুকিয়ে দিলাম ব্যাগের মধ্যে। বাইরে থাকলো কেবল শাশ্বতীদির ওয়াটার প্রুফ ক্যামেরাটা। এরপর সবাই একটা ক'রে ছোট পলিথিন মাথায় বাঁধলাম আর বড় দুটো পলিথিনের মধ্যে ব্যাগ ঢুকিয়ে কায়দা ক'রে কাঁধে নিলাম। আমরা এই কাজটুকু করতে করতেই দেখি ঝিরির উজান থেকে ভেসে আসা পানিতে পায়ের পাতা ডুবে গেছে, ছোট ছোট পাথরগুলো চোখের সামনে পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। নরখেলেই্মদাকে অগ্রবর্তী ক'রে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। এখন গা ছেড়ে তুমুল বৃষ্টি নামছে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমাদের সমতলের চেয়ে কয়েকগুণ বড়। দেখতে দেখতে হাঁটু পানি হয়ে গেল, আমরা আগে লাঠি ফেলে তারপর সাবধানে পা ফেলছি। পাথুরে পথ; ছোট, বড়, মাঝারি নানান মাপের পাথর; কোনো কোনোটার দৈর্ঘ্য মানুষ সমান, চওড়াও কয়েক হাত। পানির নিচে নানান রকম পাথর, দেখতে পাচ্ছি না, কেবল লাঠি দিয়ে অনুভব ক'রে এগোচ্ছি; এর মধ্যে প'ড়ে গেলেই গেলেই বিপদ। 

পানি এখন কোথাও কোথাও ঊরু সমান! ঝিরি যেন পাহাড়ের যোনি; কামুক জল পাহাড়ের গলা, বুক, পেট, নাভি বেয়ে খুঁজে নিয়েছে এই গুপ্ত দ্বার! বিপুল সুখে আর উচ্ছ্বাসে ঠেলে আসছে সামনে থেকে! শাশ্বতীদি এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই তার ওয়াটার প্রুফ ক্যামেরা দিয়ে প্রকৃতি এবং আমাদের ছবি তুলছে মাঝে মাঝে। আমি ছবি তোলার সময় ক্যামেরায় এক ঝলক তাকিয়ে পরক্ষণেই দৃষ্টি রাখছি নিচের দিকে, একটু অমনোযোগি হয়ে পা পিছলে পড়লেই মাথা ফাটবে না হাঁটুর বাটি ছুটে যাবে তার ঠিক কি! ভাবতে না ভাবতেই পিছলে প'ড়ে গেল আবির। দ্রুত ওর কাছে গেলাম সবাই। ওকে টেনে তুললাম, জলের ওপর পড়েছে, কোনো ধারালো পাথর ছিল না ওখানে, তাই রক্ষা। যখন দেখলাম ওর বিশেষ কিছু হয়নি, তখন আবার হাঁটতে হাঁটতে ওকে নিয়ে আমরা রসিকতা শুরু করলাম। পরাগদা ওর কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, 'কিরে, বিচি গলে নাই তো!'

'খুব মজা নিচ্ছো না, একবার পড়লে বুঝবা গলে কি না গলে!' বললো আবির।

শাশ্বতীদি পরাগদার কথা শুনতে পায়নি, কিন্তু আবিরের কথা শুনে হয়তো কিছুটা অনুমান করেছে। না বোঝার ভান ক'রে সে-ও যোগ দিলো রসিকতায়, ‘এই তোরা কী গলার কথা বলছিস রে!’ 

শাশ্বতীদির রসিকতা ধরতে পেরে আবির বললো, 'তুমিও ওদের সাথে যোগ দিচ্ছো, না! দাও, সুযোগ পেয়েছো! তবে সময় আমারও আসবে সামনে, তোমাই জামাইয়ের ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ, একটা জোঁক যদি এবার আমি না লাগায়ে দিছি, তাইলে আমার ঠাকুরদার নাম পাল্টায়ে দিও তোমরা!' 

আমি বললাম, 'তোর মরা দাদুর নাম পাল্টালেই কি আর না পাল্টালেই কি! তোর নাম পাল্টাবো।'

পরাগদা জোঁক দেখলে ভীষণ ভয় পায়। তার প্যান্টের পকেটে একটা গুলের কৌটা আছে, আর পলিথিনে লবণ আছে। ঝিরিতে নামার আগে লবণ আর গুল মিশিয়ে হাতে-পায়ে দিয়েছে। তার এই জোঁকভীতি নিয়েও আমরা খুব রসিকতা করি। পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘোরার কথা শুনলে এক পা উঁচিয়ে থাকে, কিন্তু জোঁক দেখলে ভয় পায়। আবিরের মুখে জোঁকের কথা শুনে আপসে এলো পরাগদা, 'ভাই, তুই আমার বড় আদরের ছোট ভাই, আমরা একই সরকারি দলের লোক, আমি না হয় সামান্য একটু রসিকতা করছি, তাই ব'লে তুই আমার গায়ে জোঁক দিবি? এতে তো বিরোধী দল খুশি হবে, হাততালি দেবে!'

বিরোধী দল মানে আমি আর শাশ্বতীদি। যে কোনো বিষয়ে আমার আর শাশ্বতীদির মতের বেশি মিল, আবার আবিরের সঙ্গে পরাগদার। অধিকাংশ বিষয়েই আমি আর শাশ্বতীদি একাট্টা থাকি, তুমুল তর্ক-বিতর্ক করি ওদের সঙ্গে। ওরা সরকারি দল এই জন্য যে, আমাদের ট্যুরের টাকা-পয়সা সব আবিরের কাছে থাকে, সব খরচ ওর হাত দিয়েই হয়। এজন্য আমরা ওদের বলি সরকারি দল, আর ওরা আমাদেরকে বলে বিরোধী দল। 

প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সতর্কতার সাথে ঊরু সমান পানি ভেঙে আর একের পর এক পাথর ডিঙানোর ফাঁকে গল্প-কথা আর হাসি-ঠাট্টায় দারুণ রোমাঞ্চকর ঝিরিপথ ছেড়ে উঠলাম, ঝিরি চ'লে গেছে আরো ওপরের দিকে, কিন্তু আমাদের এখন ডানদিকের একটা খাড়া চড়াই বেয়ে উঠতে হবে বগাকাইন হ্রদ বা বগা হ্রদ, কিংবা সংক্ষেপে বগালেকের পাড়ে। ঝিরির পাড়ে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বোতলের অবশিষ্ট পানিটুকু এক ঢোক ক'রে সকলে পান করলাম। খাবার পানি শেষ, এমনিতে ঝিরির পানি পান করা যায়, কিন্তু বৃষ্টি হওয়ায় ঝিরির পানি পাহাড়ী মাটি মিশ্রিত আর ঘোলা। আমরা সবাই ভীষণ পরিশ্র্রান্ত, হাঁটু কেমন কাঁপছে, একনাগাড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এখন শীত শীত লাগছে। মনে হচ্ছে, এখনই যদি একটা উষ্ণ বিছানায় কাঁথা গায়ে দিয়ে একটু গড়িয়ে নিতে পারতাম! পাহাড়ী অভিযান এমনই, একনাগাড়ে চলতে চলতে ক্লান্তি আসে, ঝিমুনি আসে, তারপর উঠে গা ঝাড়া দিয়ে আবার চলতে হয়। আসলে না চ'লে তো উপায় নেই, পাহাড়ী অরণ্যে না আছে আরামদায়ক গাড়ি, না আছে গড়িয়ে নেবার জন্য জায়গায় জায়গায় উষ্ণ নরম বিছানা! ফলে অলস মানুষও এখানে এলে কর্মঠ হয়ে ওঠে। প্রত্যেক মানুষেরই উচিত মাঝে মাঝে পাহাড়ে ট্রেকিং করা। পাহাড় মানুষকে যেমনি উদারতা শেখায়, তেমনি শেখায় লড়াই-সংগ্রাম করতে। 

বৃষ্টিস্নাত খাড়া পাহাড়ের পিচ্ছিল পথের সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করতে করতে অবশেষে আমরা পৌঁছলাম বগালেকের পাড়ে। এখন আর বৃষ্টি নেই, রোদ নেই; তবে আকাশ বেশ পরিষ্কার। চায়ের দোকানের ধোঁয়া ওঠা গরম পানির কেটলি দেখে পরাগদা দোকানের চাঙায় ব'সে বললো, 'আগে চা খেয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা করি, তারপর নিচে নামা যাবে।' 

নিচে বলতে খুব বেশি নিচে নয়; লেকের পাড়ের ঢাল দিয়ে একটুখানি এগোলেই কিছুটা সমতল জায়গা, সেখানে মাথা উঁচু ক'রে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো কাঠের ঘর, ঘরগুলো পর্যটকদের থাকার জন্য। কাঁধের ব্যাগ নামালাম চাঙায়। খাড়া পাহাড় উঠে আসায় হাঁটু এখনো কাঁপছে, তৃষ্ণায় কাতর বুক। একজগ পানি পাঁচজনে শেষ ক'রে ফেললাম। তারপর পা ছড়িয়ে বসলাম চাঙায়। বসামাত্র কোমরে দারুণ আরাম অনুভূত হচ্ছে। দোকানদারের বাড়িয়ে দেওয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মুখের কাছে ধরতেই চায়ের ধোঁয়া যেন ক্রমাগত বৃষ্টিতে ভেজা মুখের থমথমে মাংসপিণ্ডে উষ্ণ আদর বুলিয়ে দিলো! গরম রং চা মুখে আর পেটে পড়তেই শরীরটা চনমনিয়ে উঠলো, আর ক্ষিধেটাও যেন চাগাড় দিয়ে উঠলো। রোমাঞ্চকর পথের ধকলে আর অরণ্যের সৌন্দর্য উপভোগে এতোক্ষণ ক্ষিধের কথা মনেই ছিল না। নরখেলেই্মদা তার চা দ্রুত শেষ ক'রে বললো, 'আপনারা চা খায়ে আসেন, আমি গিয়ে ঘর ঠিক করি আর খাবার কথা বলি।'

'ঠিক আছে যাও।' সায় দিলো পরাগ দা। 

কিছুক্ষণ পর চায়ের বিল পরিশোধ করার পর আমরাও উঠলাম। নরখেলেই্মদা আমাদের থাকার জায়গা ঠিক করেছে একটা কাঠের দোতলায়, আর খাওয়ার ব্যবস্থা অন্য এক জায়গায়। আমরা ব্যাগ থেকে শুকনো কাপড় বের ক'রে নেবার পর নরখেলেই্মদা আমাদের ব্যাগ দুটো রেখে এলো দোতলায়। তারপর আমরা তার সাথে গেলাম পাশের আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে। একজন আর্মি চেয়ারে ব'সে আছে, তার সামনের টেবিলে একটা মোটা খাতা আর কলম; আর অন্য তিনজন আর্মি ব'সে আছে পাশের বেঞ্চে, বেড়ায় ঠেস দিয়ে রাখা তাদের বন্দুক। চারজন আর্মি-ই বাঙালি। আমরা একে একে নাম এন্ট্রি করলাম আর এর ফাঁকে ফাঁকে চললো আর্মিদের সঙ্গে গল্প; আর্মিদের প্রশ্ন আর আমাদের উত্তর, আবার আমাদের প্রশ্ন আর আর্মিদের আন্তরিক উত্তর। একজনের বাড়ি আবিরদের উপজেলায়, তিনি আবিরের বাবাকে চেনেন। 

আমার কয়েকবারের পাহাড় অভিযানে একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি যে, পাহাড়ের বাঙালি আর্মি এবং পুলিশ বাঙালিদের সঙ্গে খুবই আন্তরিক ব্যবহার করে। যেচে কথা বলে আর কথা শুরু করলে শেষ করতে চায় না। বছর কয়েক আগে এই বগা লেকেই একবার স্নানাহার সেরে সন্ধ্যা নামার আগে নাম এন্ট্রি করতে এসেছিলাম, কয়েকজন আর্মি কথা শুরু ক'রে আর শেষ-ই করতে চায় না। যখন অন্ধকার ঘনিয়ে এলো আর মশা কামড়াতে শুরু করলো, তখন অডোমাস মাখার দোহাই দিয়ে উঠতে চাইলে একজন আর্মি পকেট থেকে নতুন অডোমাস বের ক'রে দিয়ে মেখে নিতে বললো। ফেরত দিতে গেলে বললো, 'রেখে দিন আপনাদের কাছে, আমাদের অনেক আছে।' 

আর একবার থানচির পুলিশ আমাদেরকে একগাদা পেয়ারা দিয়েছিল খাওয়ার জন্য। ঝুড়ি ভরা পেয়ারা, কতো আর খাবে তারা, আঁজলা ভ'রে ভ'রে দিয়েছিল আমাদের একেকজনের তোয়ালে আর গামছায়! জীবনে অমন আন্তরিক পুলিশ দেখিনি। 

পাহাড়ের বাঙালি আর্মি না আর পুলিশের এই আন্তরিকতার বড় কারণ হলো - দিনের পর দিন পরিবার, বন্ধু-স্বজন ছেড়ে এরা অরণ্যে পড়ে থাকে; নিজেরা ছাড়া কথা বলার মানুষ তেমন পায় না। একঘেয়ে হয়ে ওঠে এদের জীবন, অরণ্যের নৈঃশব্দ যেন এদের গলা টিপে মারে। একজন আর্মি বলেছিল, 'ভাই, সখ ক'রে কেউ এই জায়গায় আসে! পয়সা খরচ ক'রে এখানে এসে কী যে মজা পান আপনারা!' এই বাক্য এমনি এমনি বলেনি সে, বলেছে দিনের পর দিন একঘেয়ে জীবন-যাপনের কারণে। আমরা যেমনি শহরের যান্ত্রিক জীবনে একঘেয়ে হয়ে উঠলে অবকাশ যাপনের জন্য সমুদ্রে-অরণ্যে ছুটি, তেমনি একনাগাড়ে থাকার ফলে এই বিজন অরণ্যও এদের কাছে একঘেয়ে হয়ে ওঠে। মুক্তি পাবার জন্য ছটফট ক'রে এরা। কথা বলার জন্য বুকের ভেতরটা আঁকু-পাঁকু করে, কথা বলার মানুষ পেলে ছাড়তে চায় না। 

তবে যে আন্তরিকতাটুকু এরা আমাদের দেখায়, সেটুকু পাহাড়ীদের প্রতি দেখালেই আমরা বেশি খুশি হই। কেননা অনেক বাঙালি স্বীকার করতে না চাইলেও আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের আর্মিরা পাহাড়ী আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন চালায়। সামান্য কারণে আদিবাসীদের মারধর করা, প্রয়োজনো-অপ্রয়োজনে তাদেরকে বাস্তুচ্যূত করা, আদিবাসী নারীদেরকে ধর্ষণ করাসহ অনেক অভিযোগ আমাদের সেনাদের বিরুদ্ধে; যার কোনোটাই ভিত্তিহীন নয়। 

সেনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গোসলের উদ্দেশ্যে এলাম বগালেকের ঘাটে। ঝড়ে উপড়ে পড়া একটা গাছের বাকলহীন ডালে জামা-কাপড় রেখে আমরা নেমে পড়লাম লেকের স্বচ্ছ পানিতে। আবির আর আমি কিছুদূর সাঁতরে গিয়ে আবার ফিরে এলাম। ভয় লাগে আমার। একে তো জলজ উদ্ভিদে পা জড়িয়ে যায়, তার ওপর এখানে নাকি অনেক বড় বড় মাছ আছে; এই ভরা যৌবনে মাছের খাবার হতে চাই না! 

বগালেকের পানি এখন দারুণ স্বচ্ছ, অনেক গভীরের মাছও দৃষ্টিগোচর হয়। বগালেকের গভীরতা আনুমানিক ১৫০ ফুট, বিস্তৃতি ১৫ একর জায়গায়। চারপাশের গাছপালার ছায়া পড়েছে পাড়ের দিকে, আর মাঝখানে আকাশ এবং মেঘের প্রতিবিম্ব। বগালেক নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে লোকগাথা চালু আছে যে, অনেককাল আগে চোঙা আকৃতির পাহাড়ের গুহায় এক অদ্ভুত প্রাণী বাস করতো, লোকে সেই অদ্ভুতদর্শন প্রাণীকে বগা নামে ডাকতো। বম ভাষার বগা শব্দের অর্থ ড্রাগন। পাহাড়ের পাদদেশে বাস করতো আদিবাসীরা, তারা বগাকে সন্তুষ্ট রাখতে নানা ধরনের জীবযন্তু ছেড়ে আসতো গুহার মুখে। হঠাৎ করেই আদিবাসীদের গ্রাম থেকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হারিয়ে যেতে শুরু করলো। সকলের সন্দেহের তীর বগার দিকে। এক রাতে গ্রামের সাহসী মানুষেরা মশাল জ্বালিয়ে লাঠি, তীর-ধনুক, বল্লম প্রভৃতি অস্ত্র নিয়ে বগার গুহায় গিয়ে তাকে আক্রমণ করলো, মানুষের হাতে প্রহৃত বগা পালানোর জন্য চেষ্টা করলে তারা বগার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলো, বগা তো মরলোই সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিষ্ফোরনে ভেঙে খান খান হলো পাহাড় আর জন্ম নিলো এক হ্রদ, তখন থেকেই এই হ্রদের নাম বগাকাইন হ্রদ বা বগা হ্রদ কিংবা বগা লেক। 

লোকগাথা লোকগাথাই, বংশ পরম্পরায় মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত লোকগাথায় যৌক্তিক তত্ত্ব কিংবা সত্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে কখনো কখনো লোকগাথার মধ্যে সত্যের একটি সুতো মিলেও যেতে পারে। ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা, লেকটি সম্ভবত মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ অথবা মহাশূন্য থেকে বৃহৎ উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ হ'লে সত্যের সুতোর মতো লোকগাথার আগুনের ব্যাপারটাই শুধু সত্য, বাকিসব মানুষের কল্পনা। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ হবার সম্ভাবনাই বেশি, লেকের তলদেশে উষ্ণ পানির একটি প্রস্রবণ রয়েছে, এপ্রিল-মে মাসে প্রস্রবণ থেকে উষ্ণ পানি বের হবার সময় লেকের পানির রঙ বদলে ঘোলাটে হয়ে যায়। 

হৃদয় স্তব্ধ করা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁঝির কোরাস, অরণ্যের নাম-না-জানা পাখির সুর। সামনে বগা লেকের নিস্তরঙ্গ জলরাশি। মাথার ওপর বহুদূরে জ্বলজ্বল করছে অজস্র নক্ষত্র। মনে হচ্ছে, আমি যেন ওই দূর নক্ষত্রজগতের অসংখ্য নক্ষত্রের ভেতর থেকে টুপ ক'রে খসে পড়েছি এখানে, মনে হচ্ছে ভিন্ন এক জগতে এসে পড়েছি হঠাৎ! মনে হচ্ছে এই জগতে কেউ নেই, আমি একা! 

আজ চানরাত, কাল ঈদ। এ কারণেই আমরা ছাড়া আর মাত্র কয়েকজন পর্যটক আছে; কাল থেকেই হয়তোবা পর্যটক বাড়তে শুরু করবে। পর্যটক বেশি থাকলে এতোটা সুনসান থাকে না, এদিক-সেদিক দিয়ে পর্যটকরা হাঁটাচলা করে, মদ্যপান ক'রে জোরে জোরে কথা বলে, গান গায়, কোথাও আগুন জ্বালিয়ে বারবিকিউ করে। তখন বগা লেকের আসল সৌন্দর্য আর হৃদয় হিম করা নীরবতা উপভোগ করা যায় না, এখন যেমন যাচ্ছে। 

আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ছি আমি। এমনিতেই আমি আবেগী মানুষ, তার ওপর আবার পেটে তিন পেগ পড়েছে। তিন পেগ পেটে চালান করেই আমি এখানে চ'লে এসেছি একা একা সময় কাটাবো ব'লে, নিজের মুখোমুখি হবো ব'লে। পরাগদা, শাশ্বতী আর আবির এখানো ঘরে ব'সে পান করছে। আমি সখের পানশৌণ্ড, ন'মাসে-ছ'মাসে একবার পান করি। পান করলেই খুব আবেগাক্রান্ত হই আর শায়লাকে মনে পড়ে। চিৎকার ক’রে কাঁদতে ইচ্ছে করে, অথচ আমি নীরবে কাঁদি। বাইরে থেকে দেখে অনেকেই আমাকে অরসিক অবেগশূন্য মানুষ মনে করে। আমার সাথে যারা গভীরভাবে মেশে, কেবল তারাই পড়তে পারে আমার হৃদয়টা। আমাকে জানে পরাগদা, শাশ্বতীদি আর আবির। 

এক বছর হলো, শায়লার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভেঙে গেছে। আমার অপরাধ? আমি নাস্তিক! আমাদের সম্পর্ক হবার আগে থেকেই আমি নাস্তিক, শায়লা তা জানতো। কিন্তু তখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ওর কোনো অসুবিধা হয়নি। ও নাকি ভেবেছিল, নাস্তিকতা আমার পাগলামি, এক সময় আমার মাথা থেকে নাস্তিকতার ভূত চ’লে যাবে; মুখে মুখে নাস্তিকতার কথা বললেও ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনেই ওকে বিয়ে করবো। কিন্তু যখন একের পর এক ব্লগার খুন হতে থাকলো, তখন থেকেই ও আমাকে লেখালেখি বন্ধ করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলো। কিন্তু যখন দেখলো যে, নাস্তিকতা কেবল আমার মুখের বুলি নয়, আমি হৃদয়েও ধারণ করি। ধারণ করি অসাম্প্রদায়িক-মানবিক চেতনা, তখনই ঘুরে দাঁড়ালো ও। ১৪৪ ধারা জারি করলো আমার ওপর যে, আমি যদি নাস্তিকতার পথ ছেড়ে ধর্মের পথে না ফিরি তাহলে ও আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না। আমি বলেছিলাম, আমরা কোর্টে রেজিস্ট্রি ক’রে বিয়ে করবো। বিয়ের পর তুমি ধর্ম পালন করলে আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু আমাকে ধর্ম পালনের জন্য চাপাচাপি করতে পারবে না। কিন্তু ও অনড় ছিল, আমিও ওর শর্ত মানতে পারিনি। আমি ওকে ভালবাসি, ভীষণ ভালবাসি, ওর জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত; কিন্তু কখনোই আমি আমার আদর্শ, বিশ্বাস, নৈতিকতা, সত্তা বিসর্জন দিতে পারবো না। আমি আমার মনুষ্যত্ব বিকিয়ে সাজানো ধার্মিক হতে পারবো না। পারিওনি; তাই দু’জনের পথ বদলে গেছে। ও হয়তো সহজেই ভুলে গেছে যে, দু’বছর আগে এই বগা লেকেই আমরা কী দারুণ সময় কাটিয়েছি! ও হয়তো ভুলে গেছে যে, রুমা বাজারের একটা হোটেলে আমরা প্রথম রাত্রিযাপন করেছি আর শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছি। গত মার্চে ওর বাগদান হয়েছে এক প্রবাসী ছেলের সঙ্গে। ও হয়তো অনেক কিছুই ভুলে গেছে, আমিও ভুলতে চাই; কিন্তু পারি না। বার বার অশরীরি শায়লা আমার কাছে আসে; যখন যে কল্পনা করি; তার মধ্যেই ও ঢুকে পড়ে। আমি হয়তো ওকে ভুলতে পারবো না কোনোদিন, দূর থেকে সারাটা জীবনই ওকে ভালবেসে যাব! 

আমার একলা মগ্ন চৈতন্যের ঘোর কাটলো শাশ্বতীদির উচ্চস্বরের ডাকে, 'সবুজ...সবুজ...।'

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দোতলার দিকে দৃষ্টি ছুড়ে দিলাম। দূর থেকে শাশ্বতীদিকে ভালভাবে দেখতে না পেলেও ঘরের আলোর একফালি চুইয়ে তার পিঠের দিকে পড়ায় অনুমান করতে পারলাম যে, ওটাই শাশ্বতীদি। আমি সাড়া দিলাম, 'আমি এখানে দিদি।' 

'কী করছিস?'

'এমনি ব'সে আছি।'

'আমি আসছি।'

(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন