আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সাইমুম (উপন্যাস: শেষ পর্ব)

লিখেছেন উজান কৌরাগ


শাশ্বতীদি এসে বসলো আমার পাশে, 'এই তুই একা একা এখানে এসে ব'সে আছিস, কাছেই পানি, যদি প'ড়ে যেতি।'

'ধুর, তুমি আমাকে অতো মাতাল ভাবো! আমি মাত্র তিন পেগ খেয়েছি।'

'এখানে মশা কামড়াচ্ছে না রে?'

'না, অডোমাস মেখেছি ভাল মতো। ওরা কী করছে?'

'ওরা এখন দার্শনিক বনে গেছে!'

কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর শাশ্বতীদি আবার বললো, 'তোকে বলবো বলবো ক'রে আর বলা হয়নি; আমি না একটা কাণ্ড ক'রে ফেলেছি।'

'কী কাণ্ড?'

'আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছি তনয়ের মাধ্যমে।'

'কবে পাঠিয়েছ?'

'তনয় আজকে বাড়ি গেছে, নিশ্চয় এতোক্ষণে চিঠি পৌঁছে দিয়েছে ওর মামা-মামির কাছে।'

'পরাগদা জানে?'

'না। তুই বলিস না ওকে। আগে দেখি, কী রেজাল্ট আসে, তারপর বলবো। হাতে লেখা চিঠিটা আমি টাইপ ক'রে রেখে দিয়েছি।' শাশ্বতীদি মোবাইলে চিঠিটা বের ক'রে এগিয়ে দিলো আমার দিকে, 'প'ড়ে দেখ।'

আমি মোবাইল হাতে নিয়ে চোখ রাখলাম স্ক্রীনে -


মা-বাবা,
আমার প্রণাম ও ভালবাসা নিও। পলককে আমার স্নেহাশীষ জানিও। তোমাদেরকে আমি তুমি করেই বলছি, কেননা তোমরা তো আমার দূরের মানুষ নও; আমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর মতোই তোমরা এখন আমার শ্রদ্ধা-ভালবাসার মানুষ, আপনজন। আপনজনকে আমার আপনি বলতে ইচ্ছে করে না, তাই তোমাদেরকে তুমি করেই বলছি। মা-বাবা, তোমরা কেমন আছো? নিশ্চয় ভাল আছো; পরাগকে তোমরা দূরে সরিয়ে দিলেও এখনো তো তোমাদের সামনে পলক আছে, পলক এখন তোমাদের চোখের মণি, তোমাদের ভবিষ্যৎ। অবন্তীদি আছে, জামাইবাবু আছে, ফুটফুটে দুটো নাতি-নাতনিও আছে তোমাদের। তনয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, পলকের জন্য সু-পাত্রী খুঁজছো। সু-পাত্রী নিশ্চয় পেয়ে যাবে, নিশ্চয় পলকের বউ হবে তোমাদের মনের মতো বউ। তোমরা ভালই আছো, ভাল থাকো, তাই-ই চাই। মা, আমরা ভাল নেই; বাবা, আমাদেরও ভাল থাকতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু কী ক'রে ভাল থাকবো, বলো? গত এক দশক আমি আমার বাবা-মাকে দেখি না, আর পরাগ তোমাদেরকে দেখে না পাঁচ বছর। বাবা-মা থাকতেও আমরা মাকে মা, বাবাকে বাবা ব'লে ডাকতে পারি না। মানুষ এক জীবনে কতো বছর বাঁচে, বলো? সত্তর-আশি-নব্বই কিংবা একশো বছর? এই ছোট্ট জীবনে বাবা-মাকে পায় আরো অল্প সময়ের জন্য; আর এই অল্প সময় থেকে যদি রাগারাগি কিংবা মান-অভিমানে আরো পাঁচ-দশ বছর চ'লে যায়, তবে আর থাকেটা কী, বলো? আমরা বড় দুর্ভাগা!
এই দেখ না, ঈদের ছুটিতে বেশিরভাগ মানুষ শিকড়ের টানে কেউ বাড়ি যাচ্ছে, কেউবা যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু আমি আর পরাগ? আমরা না যেতে পারছি বাবার বাড়ি, না যেতে পারছি শ্বশুরবাড়ি। ভাইবোন-আত্মীয়-স্বজন থেকেও এখন আমাদের না আছে কোনো ভাইবোন, না আত্মীয়-স্বজন। ব্যতিক্রম কেবল তনয়, ও-ই মাঝে মাঝে বাসায় আসে, বৌদি ব'লে ডেকে আমার প্রাণ জুড়ায়। এজন্য ওকে গঞ্জনাও সইতে হয়। আমি এবার পরাগকে বলেছিলাম, 'চলো, আমরা গিয়ে বাড়ি উঠি, আমাদেরকে তো আর কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেবে না।' কিন্তু জানো তো, তোমাদের বড় অভিমানী ছেলে, একদিন দূর ক'রে দিয়েছিলে, তাই না ডাকলে আর ফিরে যাবে না কোনোদিন; কেবল তোমাদের জন্য কষ্ট পাবে আর চোখের জল ফেলবে। জানো, মা, ও মাঝে মাঝেই ঘুমের মাঝে তোমাকে স্বপ্নে দেখে 'মা' ব’লে চিৎকার ক'রে ওঠে। আমি হয়তো তখন জেগে থাকি কিংবা ওর চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি স্বপ্ন দেখার পর ও বাচ্চা ছেলের মতো হু হু ক'রে কাঁদছে। ওর কান্না আমাকেও ছোঁয়, আমরা দু'জন দু'জনকে ছুঁয়ে বিছানায় ব'সে কাঁদি।
মা-বাবা, তোমাদের কাছে এবং আমার বাবা-মা’র কাছে আমরা দু’জনই অপরাধী। তোমাদের ভাষায় পরাগের অপরাধ, ও একটা ছেলের সঙ্গে সংসার করছে, তাও আবার মুসলমান ছেলে; আর আমার বাবা-মায়ের ভাষায় আমার অপরাধ, আমি ছেলে হয়ে নিজেকে মেয়ে পরিচয় দিয়ে একটা ছেলের সঙ্গে সংসার করছি। তার ওপর আবার আমরা বিয়েই করিনি!
মা, এটা কি নিন্দনীয় কিছু? বাবা, এটা কি আমাদের অপরাধ? তোমাদের ছেলে আর আমি না হয় কোনো প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী নই, নাস্তিক; কিন্তু তোমরা তো ধর্মে বিশ্বাস করো, পৌরাণিক দেব-দেবীদের কাহিনী বিশ্বাস ক'রে তাদেরকে পূজা করো। আমাদের দু'জনের মিলন যদি অপরাধ হয়, তবে বহুকাল আগেই তোমাদের অনেক দেব-দেবী সেই অপরাধে অপরাধী। তাহলে আমাদের মতো তোমরা তাদেরকে কেন বর্জন করছো না; কেন তাদেরকে মণ্ডপে স্থান দিয়ে ফুল-মালা-চন্দন পরিয়ে, নিজেরা ব্রত থেকে ঘটা ক'রে পূজা করছো? পরাগের মুখে শুনেছি, তোমরা বছরে একবার বাড়িতে নারায়ণ পূজা করো; নারায়ণের অন্য নাম বিষ্ণু। বাবা-মা, দেবতা এবং অসুরদের সমুদ্রমন্থনের গল্প তোমরা নিশ্চয় জানো, সমুদ্র মন্থন ক'রে অমৃত পাওয়া গেলে সেই অমৃত নিয়ে দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে, আর দ্বন্দ্ব নিরসনে স্বয়ং বিষ্ণু মোহিনী মায়ায় স্ত্রী রূপ ধারণ ক'রে দানবদের কাছ থেকে অমৃত নিয়ে দেবতাদের পান করিয়েছিলেন। মা, আমি শুনেছি তুমি শিব পূজা করো। জানো নিশ্চয় মহিষাসুরের বোন মহিষীকে বধ করার জন্য বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করেছিলেন, আর শিব এবং মোহিনীরূপী বিষ্ণুর মিলনের ফলে জন্ম হয়েছিল অয়প্পানের। মা, পরাগ যদি অপরাধী হয়ে থাকি, তাহলে শিবও তো সমান অপরাধী; আমি যদি পাপী হয়ে থাকি, তাহলে বিষ্ণুও তো পাপী। কিন্তু তোমরা সেই শিব-বিষ্ণুকে পূজা করছো, অথচ নিজেদের গর্ভজাত-ঔরসজাত সন্তান আর তার স্ত্রীকে ত্যাগ করেছ! তোমাদের বিশ্বাস মতে ধরেই নিলাম যে, পরকাল আছে, কিন্তু পরকালে গিয়ে ভগবান শিব আর বিষ্ণুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের সন্তানকে ত্যাগ করার প্রশ্নে কী জবাব দেবে তোমরা?
বাবা-মা, তোমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে রূপান্তরকামিতার গল্প অনেক আছে, আছে তাদের বিয়ে এবং সংসার করার গল্পও; সেখানে এই বিয়েকে কেউ পাপ বলেনি, স্বাভাবিক বিয়ে বলেই গণ্য করেছে। যদিও আমি আর তোমাদের ছেলে প্রথাগত নিয়েমে বিয়ে করিনি; কিন্তু এই যে আমরা দু'জন দু'জনকে ভালবেসেছি, কাছে এসেছি, একসঙ্গে জীবন-যাপন করছি; এটাই আমাদের কাছে বিয়ে। শুধু আমাদের কাছে কেন, ধর্মমতেও এটা বিয়ে। তোমাদের নিশ্চয় মহাভারতের দুষ্মন্ত এবং শকুন্তলার কথা মনে আছে। মহারাজ দুষ্মন্ত মৃগয়ায় গিয়ে ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত হয়ে কন্ব মুনির আশ্রমে গিয়েছিলেন; কন্ব আশ্রমে ছিলেন না, ছিলেন তার কন্যা শকুন্তলা। শকুন্তলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজা দুষ্মন্ত তাকে তাঁর ভার্যা হবার অনুরোধ জানালে শকুন্তলা তার পিতার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু রাজা দুষ্মন্ত তাকে ধর্মানুসারে গান্ধর্বমতে বিয়ে করার কথা বলেন; যে বিয়েতে কোনো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয় না, কোনো তৃতীয় পক্ষের স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় না, পাত্র-পাত্রী নিজেরাই নিজেদেরকে পছন্দ ক'রে একে অন্যের কাছে সমর্পণ করেন। রাজা দুষ্মন্ত আর শকুন্তলাও গান্ধর্ব মতেই একে-অন্যের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তারপর রাজা চ'লে যাবার পর কন্ব মুনি আশ্রমে ফিরে এলে লজ্জিত-বিব্রত শকুন্তলা পিতার কাছে গেলেন না, কন্যার এই সংকুচিত ভাব লক্ষ্য ক'রে কন্ব মুনি দিব্যদৃষ্টিতে সব জানতে পারেন এবং প্রীত হয়ে কন্যাকে জানান যে সে কোনো পাপ করেনি, নির্জনে বিনামন্ত্রপাঠে সকাম পুরুষের সকামা স্ত্রীর সঙ্গে যে মিলন, তাকেই গান্ধর্ব বিবাহ বলে, এটাই শ্রেষ্ঠ বিবাহ। এবার তোমরাই বলো, মা-বাবা, আমরা কি কোনো অপরাধ করেছি? আমরা তো ধর্মানুসারেই একজন আরেকজনের কাছে এসেছি, ভালবেসেছি, গান্ধর্ব বিবাহ করেছি।
আজকাল চারদিকে তাকালেই দেখতে পাই যে অনেক নারী-পুরুষ নিজেরা পছন্দ ক'রে অথবা পরিবারের পছন্দ মতে বেশ ঘটা ক'রে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, শত শত কি হাজার মানুষকে খাইয়ে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে জৌলুস ছড়িয়ে বিয়ে করছে; তোমাদের ভাষায় এই সম্পর্ক চিরন্তন, স্বাভাবিক, মঙ্গলজনক। কিন্তু কিছুদিন বাদেই অনেকেরই ডিভোর্স হচ্ছে, আবার তারা বিয়ে করছে একইভাবে। এভাবে কেউ কেউ চার-পাঁচটি বিয়েও করছে। আর তোমাদের ভাষায় আমাদের সম্পর্ক চিরন্তন না হলেও, বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে বিয়ে না করেও, একে-অন্যের সঙ্গে আমরা বারো বছর কাটিয়ে দিলাম। আমাদের এই বারো বছরের প্রেম-ভালবাসা, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ; এ কি সত্য নয়, মা? এ কি চিরন্তন নয়, বাবা?
মা-বাবা, আমি জানি যে, আমাদের জন্য সমাজের মানুষের কাছে তোমাদের মাথা হেঁট হয়েছে, তোমাদের হয়তো অনেক তীক্ষ্ণ কথা শুনতে হয়েছে; নিশ্চয় এখানো মানুষ তোমাদেরকে বিব্রত করে। কিন্তু যে সমাজ অন্ধ, সেই সমাজের মানুষের কাছে তোমরা কেন মাথা হেঁট করবে? যে সমাজ কূপমণ্ডূক, সেই সমাজের মানুষের কথা তোমরা কেন গায়ে মাখবে? আমাদেরকে তোমরা বুকে নাইবা ঠাঁই দিলে, কিন্তু তোমরা মানুষের মাঝে মাথা উঁচু ক'রে বাঁচো। তোমরা যেমনি কোনো অপরাধ করোনি, তেমনি অপরাধ করিনি আমরাও। কেউ ফোঁড়ন কাটতে এলে তাকে শুনিয়ে দাও তারই ঘরের ঠাকুরের আসনে বসা বিষ্ণুর মোহিনী রূপের গল্প, বিষ্ণু আর শিবের মিলনের গল্প।
বাবা, তনয়ের কাছে শুনেছি তোমার ডায়াবেটিসের কথা। কিন্তু তুমি নাকি চুরি মিষ্টি খাও? বাড়িতে মা এখন মিষ্টি রাখে না ব'লে তুমি নাকি বাজারে গিয়ে অনাথ ঘোষের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাও? প্লিজ, বাবা, একটু নিয়ম ক'রে চ'লো; সকাল-বিকাল একটু হেঁটো। পলকের জন্য মেয়ে খুঁজছো, নাতি-নাতনির মুখ দেখে যেতে হবে না!
মা, তুমিও নাকি অনিয়ম করো, নিজের শরীরের প্রতি ঠিক মতো যত্ন নাও না? প্লিজ, মা, তোমরা দু'জনেই একটু নিয়ম ক'রে চ'লো। এই পৃথিবীতে তোমাদের থাকতে হবে আরো অনেকদিন। ভাল থাকো তোমরা, আনন্দে থাকো।
ইতি
তোমাদের বৌমা
শাশ্বতী
চিঠি পড়া শেষ হ'লে আমি মোবাইলটা নিচের দিকে ধরলাম যাতে আলো মুখে না পড়ে। এমনিতেই শায়লার কথা ভাবতে ভাবতে মনটা ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল, আর এই চিঠিটা প'ড়ে এখন আমার ভেতর বড় কাঁদছে। শাশ্বতীদি আর পরাগদার বাবা-মা ওদেরকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, কিন্তু আমার বাবা-মা আমাকে দূরে ঠেলে দেয়নি; আমি তাদের কাছেই আছি। একই বাড়িতে থাকছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি; তবু মনে হয়, তারা আমার থেকে অনেক দূরে আছে, আমার বাবা-মাকে আমার মতো ক'রে পাচ্ছি না; যেভাবে আগে পেতাম। দু'দিনের পৃথিবীতে মানুষের সংকটের শেষ নেই!

চিঠি প'ড়ে আমি স্তব্ধ হয়ে ব'সে আছি, হৃদয় ব'লে যদি কিছু থাকে, তবে এই চিঠি পড়ার পরও কি কোনো বাবা-মা পারে তার সন্তান কিংবা সন্তানসম বৌমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে? যদি পারে, তবে পাষণ্ড সেই বাবা-মা!

আমার নীরবতার অবসরে নৈঃশব্দ অন্ধকারে শাশ্বতীদি হঠাৎ গেয়ে উঠলো -

'নীড় ছোট ক্ষতি নেই
আকাশ তো বড়
এ মন বলাকা মোর অজানার আহ্বানে
চঞ্চল মাখা মেলে ধর...'

ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলো নরখেলেই্মদার ডাকে, দরজার কড়া নাড়তে নাড়তে সে ডাকছে, 'দাদা, ওটেন। দাদা...।'

চোখ মেলে দেখি খোলা জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে মেঘ ঢুকছে! ওরা তিনজন এখনো ঘুমোচ্ছে। গায়ের কম্বল সরিয়ে উঠে দরজা খুললাম, নরখেলেই্মদা বললো, 'রেডি হন, একনই রওনা করি।'

আমি ওদেরকে জাগিয়ে ব্রাশ নিয়ে বাইরে এলাম। সাদা মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে পুরো বগালেক। পুরু মেঘের কারণে অল্প দূরের জিনিসও ঝাপসা দেখাচ্ছে। আর বেশি দূরে তো মেঘ ছাড়া অন্য কিছু দেখাই যাচ্ছে না। বেশ শীতও লাগছে। সমতলে এখন গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত, আর এখানে কাল সারারাত ঘুমিয়েছি কম্বল গায়ে দিয়ে!

প্রাতঃকৃত্য সারতে টয়লেটে ঢুকলাম, বেরিয়ে দেখি চারদিক পরিষ্কার, দূরের গাছপালাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে; আসলে ডাকাত বাতাস বগালেকের শরীর থেকে খুলে নিয়ে গেছে মেঘের আবরণ! সকালবেলার বগালেক আমাদের মিরপুরের এক পাগলীর মতো; এই শরীরে কাপড় আর একাগাদা ছেঁড়া ন্যাতা, তো কিছুক্ষণ পরই সম্পূর্ণ নগ্ন!

ফ্রেশ হয়ে নাস্তা ক'রে মিনিট তিরিশের মধ্যে যাত্রা শুরু করলাম কেওক্রাডাংয়ের পথে। ঘরটা আবার বুকিং দিয়ে গেলাম, আজ আর কাল কেওক্রাডাং কাটিয়ে পরশু রাত আবার এখানে থাকবো, তার পরদিন বান্দরবান গিয়ে ধরবো ফেরার বাস। বগালেক থেকে কেওক্রাডাং তিনঘন্টার পথ। আমাদের কোনো তাড়া নেই, আজ আর কাল বরাদ্দ কেওক্রাডাংয়ের জন্য; সুতরাং ধীরে-সুস্থে কাছে-দূরের পাহাড়, গাছপালা আর মেঘপুঞ্জ দেখতে দেখতে যেতে চাই।

কোথাও গাঢ় সবুজ পাহাড়, আবার কোথাও হালকা সবুজ। পাহাড়ের মাথায় এই রোদ্দুর তো এই ছায়া, আলো-ছায়ার নয়নাভিরাম লুকোচুরি! মাঝপথে পর্যটকদের সাময়িক বিশ্রামের জন্য একখানা বেড়াহীন টিনের দো-চালা ঘর, বসার জন্য তিনদিকে চাঙা পাতা। হাত-পা ছড়িয়ে ব'সে পড়লাম সবাই। আমাদের পায়ের নিচে এবং পাহাড়ের ঢালে ছড়ানো-ছিটানো কলার খোসা, চকলেট-চিপসের মোড়ক, সিগারেটের প্যাকেট ইত্যাদি। এসব আমাদের মহান বাঙালিদের কীর্তি! পাহাড়ে বেড়াতে এলে পণ্যের মোড়ক, প্লাস্টিক প্রভৃতি ব্যাগে জমিয়ে রেখে পরে নির্দিষ্ট ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে হয়, যাতে পাহাড়ের পরিবেশ নষ্ট না হয়; কিন্তু সেই বোধ অধিকাংশ বাঙালি পর্যটকের নেই।

আমাদেরই বয়সী এক যুবক একটা গাধা তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে বগালেকের দিকে। নরখেলেই্মদার কাছ থেকে জানতে পারলাম, ও বগালেকে নয়, যাচ্ছে রুমাবাজার। রুমাবাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনে নিয়ে আবার ফিরে আসবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী বিভিন্ন পাড়ার দোকানে বিক্রি ক'রে ছেলেটি।

আমাদের এর পরের চা-বিরতি দার্জিলিংপাড়ায়। ছবির মতো সুন্দর গ্রামটি। কলা-বিস্কুট খেয়ে, চা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছি পাড়াটা। গাছপালা-মানুষ থেকে শুরু ক'রে মুরগী-কুকুর সবকিছুর ছবি ধারণ করছে শাশ্বতীদির ক্যামেরা। আমি মাঝে মাঝে ক্লিক করছি। ঘুরতে ঘুরতে আমরা একটা চার্চের সামনে এসে দাঁড়ালাম; চার্চের বেড়া বাঁশের চাটাইয়ের, ছাউনি টিনের। ছাউনির বাটামের সাথে বাঁধা একটা মাইক। কোনো লোকজন নেই, ঘরে তালা দেওয়া। এই চার্চওয়ালারা প্রলোভন দেখিয়ে আর মাথায় হাত বুলিয়ে বহু আদিবাসীকে ধর্মান্তরিত করেছে। নষ্ট করেছে আদিসবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবিরের তাড়া খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম কেওক্রাডাংয়ের পথে।

রাতে কম্বল গায়ে জড়িয়ে বারান্দার চেয়ারে ব'সে আছি আমরা চারজন, কারো মুখে কোনো কথা নেই। কথা বলবো কী? এখন তো কথা বলছে প্রকৃতি, নাচছে, গাইছে! আমরা রীতিমতো বাকরুদ্ধ প্রকৃতির সাবলীল নৃত্যনাট্য দেখে! আদিবাসী নারী যেমনি মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত গহনায় সাজায়, তেমনি পাহাড়ও সেজেছে মেঘের গহনায়; পরেছে মেঘের ঘাঘরা, বুকে মেঘের উত্তরীয়! দিগন্তে আকাশ ছড়াচ্ছে আলোর রোশনাই; মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, যেনবা চমকে চমকে মুঠোয় মুঠোয় উড়িয়ে দিচ্ছে দোলের বর্ণিল আবির! আকাশকে মনে হচ্ছে খুব কাছে। আমরা যেমনি বিদ্যুৎ চমক আর আকাশের এই বর্ণিল রূপ দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে আছি, তেমনি প্রতিদিন প্রতিক্ষণ পৃথিবী এমনিভাবে আরো কতো বিচিত্র রূপ ধারণ করছে, আমরা তার কতোটুকুই বা দেখতে পাই! ঠিক এই সময়েই পৃথিবীর আনাচে-কানাচে হয়তো কতো বিস্ময়কর নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি হচ্ছে, যা হয়তো কেবল পশু-পাখিরাই দেখতে পাচ্ছে; কোনোদিন মানুষের পা-ই পড়েনি সেখানে!

অন্ধকার রাত্রে আশশ্যাওরা কিংবা ভাঁটফুল গাছে কিছু জোনাকি বসলে যেমন লাগে, অনেক নিচে দূরে দূরের রুমাবাজার, দার্জিলিংপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামকেও এখান থেকে ঠিক তেমন লাগছে। গভীর নিঃশব্দ পরিবেশে শাশ্বতীদি হঠাৎ গেয়ে উঠলো -

'মেঘ রাঙানো পদ্ম আকাশ
দিগন্তে কতো রঙ ছড়ায়
তোমার বাঁশি আমার প্রাণে
মৌমাছিদের সুর ঝরায়।
ভালবাসার স্বপ্ন আনে
অলির প্রাণে ফুলবাহার
সাদা মেঘের পাখায় পাখায়
উধাও হলো মন আমার...'

অনেক রাতে ঘুমানোর কারণে একটু দেরিতেই ঘুম থেকে উঠেছি। তারপর চা-নাস্তা খেয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চ'লে এসেছি পাসিং পাড়ায়। অসম্ভব সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন এই পাড়াটি। পাড়াটি লম্বা আকৃতির; দু'পাশে জঙ্গলময় খাদ, সবুজ পাহাড়ের পর পাহাড়। এখানে একটি স্কুল আছে, আশপাশ থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। স্কুলের ক্লাসরুমগুলোর দরজা খোলা। স্থানীয় একজনের অনুমতি নিয়ে দুটো বেঞ্চ বাইরে বের ক'রে এনে আমরা বসলাম। সামান্য দূরে ছোট্ট একটা দোকান, নরখেলেই্মদা দোকানদারের সঙ্গে গালগল্প করছে, আবির গলা চড়িয়ে চায়ের কথা বলতেই আমাদের জন্য চা পাঠিয়ে দিলো। পাসিংপাড়ার চারপাশের সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধ বাতাস উপভোগ করতে করতে চলছে আমাদের আড্ডা, কবিতা আবৃত্তি আর গান। সময় যে কী ক'রে ব'য়ে চলেছে, বুঝতেই পারছি না! হঠাৎ একটু তালভঙ্গ হলো পরাগদার মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠায়। পরাগদা পকেট থেকে মোবাইল বের ক'রে স্ক্রীনে দৃষ্টি বুলিয়েই বিস্ময়ে তাকালো শাশ্বতীদির দিকে, তারপর আবার মোবাইলের স্ক্রীনে।

শাশ্বতীদি বললো, 'কে?'

'মা।' পাঁচ বছর তার মোবাইলে মায়ের ফোন আসে না।

শাশ্বতীদি বললো, 'ধরো।'

পরাগদা ফোন ধরলো, 'মা...।'

পরাগদা ফোন ধ'রে আছে কানে; সে কিছু বলছে না, শুধু শুনছে। আমরা তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। আমি তো শাশ্বতীদির চিঠির কথা জানি, তাই আমার ভেতরে উত্তেজনা আর কৌতূহল। পরাগদার চোখ ছলছল করছে। পরাগদা বলছে, 'আসবো, বান্দরবান থেকে ফিরে আমরা আসবো।... নাও, কথা বলো।'

পরাগদা মোবাইল বাড়িয়ে দিলো শাশ্বতীদির দিকে।

কেওক্রাডাংয়ে আজ আমাদের দ্বিতীয় রাত। আমি কেওক্রাডাংয়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, একা। মাথার ওপরে উন্মুক্ত আকাশ, আকাশের বুকে জ্বলতে থাকা অজস্র নক্ষত্র আর পৃথিবীর সবেধন অপুষ্ট-অনুজ্জ্বল চন্দ্রমণি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩১৯৬ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে নক্ষত্ররাজিকে অনেক বড় মনে হচ্ছে। আমি মোবাইলে Leo Rojas-এর প্যান ফ্লুট ছেড়ে দিলাম। Juan Leonardo Santillia Rojas, ইকুয়েডরের তরুণ শিল্পী; আমার ভীষণ প্রিয়। দিনে-রাতে যখনই Rojas-এর Der ensame Hirte, El condor pasa কিংবা circle of life শুনি; আমার হাত দুটো অসংখ্য পালকসমৃদ্ধ ডানা হয়ে যায়, মানুষ থেকে আমি হয়ে যাই হলদে পাখি। এই এখন যেমন হলদে পাখি হয়ে উড়ছি, উড়ছি তো উড়ছি-ই! আমার উড়ানযাত্রা থামছে না; আমি উড়ে বেড়াচ্ছি চৈনিক, এশিরিয়া, ব্যাবিলন, সুমেরীয়, মিশরীয়, হিব্রু, গ্রীক, রোমান, মায়া, ইনকা সভ্যতার ওপর দিয়ে। অনেক নদী-সমুদ্র-পাহাড় পেরিয়ে ইনকা সভ্যতার মাচুপিচু নগরের ভূমি স্পর্শ করতেই আমি মানুষ হয়ে গেলাম আর দেখা পেলাম অনেক মানুষের। প্রাণোচ্ছল, সংগীত-নৃত্যপিপাসু মানুষের নগর মাচুপিচু। আমি এক অচেনা নারীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার অতিথি হলাম। তার কথায় যেন জাদু আছে, গান গাইতেও জানে। তার সুরেলা গলার গানে আমার প্রাণের তৃষ্ণা মিটলো! তারপর তার বড়িয়ে দেওয়া সুস্বাদু লামার মাংস খেতে খেতে চিচার পাত্রে চুমুক দিলাম। পাত্র শূন্য ক'রে আরেকপাত্র চিচার অনুরোধ জানাতেই আমি তার দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম! কোথায় অচেনা নারী? এতো শায়লা!

শায়লা, শায়লা, শায়লা! যেন আমার এক মনোরোগের নাম শায়লা! ভুলে থাকতে চাই, কিন্তু বারবার আসে, ওকে ভুলে থাকতে অন্য নারীকে কল্পনা করি, কিন্তু সেই অন্য নারী একসময় হয়ে যায় শায়লা! তখন জীবনের সকল আগ্রহ হারিয়ে যায়!

হাতের পান পাত্রে চুমুক দিয়ে কেওক্রাডাং চূড়ার ছাউনির অর্ধ দেয়ালের ওপর রাখলাম, সুরে ভাসতে ভাসতে তাকিয়ে আছি আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে। জীবনে এতোসব অপ্রাপ্তি, এতো অবহেলা, বঞ্চনা, ঘৃণা; তবু ঐ আকাশ, নক্ষত্র ও চারিপাশের এই সুন্দর প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে যখনই মনে হয় একদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকবো না আর আমি এসব কিছুই দেখবো না; তখন ভেতরটা হুহু ক'রে ওঠে, শীতের শেষের বাতাসের মতো হাহাকার ক'রে বুকের ভেতর! নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে এলো জীবনানন্দের পংক্তি -

'কোথাও চলিয়া যাব একদিন - তারপর রাত্রির আকাশ
অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কত কাল জানিব না আমি...'

কোথায় যাব? ম'রে যাব। এই পৃথিবীর বাতাসে মিশে যাবে আমার বুকের শেষ বাতাসটুকু, এই পৃথিবীর মাটিতে মিশে যাবে আমার দেহ। চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে যাব আমি।
'

প্রাণপ্রাচুর্যে শোভিত সত্যিকারের ছায়াময়-মায়াময় জঙ্গল ছেড়ে পাঁচদিন পর ফিরলাম ধাতু-কংক্রিটের নিষ্ঠুর জঙ্গলে! বান্দরবানের সঙ্গে আমার নাড়ীর টান নেই, নেই কোনো রক্তের সম্পর্কের স্বজন; তবু বান্দরবান থেকে ফিরে আসার সময় প্রেয়সীকে ছেড়ে আসার মতোই মন কেমন করে, ফিরে আসার পরও হৃদয় আচ্ছন্ন ক'রে রাখে বান্দরবানের বিপুল বৃক্ষরাজি, বিস্তীর্ণ সবুজ পাহাড়, বর্ষার খরস্রোতা সাঙ্গু নদী, বিস্ময় জাগানো ঝিরিপথ, অপার মেঘসমুদ্র আর প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা সহজ-সরল মানুষ; সবকিছু যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে! এই মন-কেমন-করা ভাবটা বেশ কয়েকদিন থাকে।

বাসার সামনে এসে থামলো রিক্সা। মন চাইলেও শরীর চাইছে না রিক্সা থেকে নামি, সারা শরীর ব্যথা। প্রত্যেকবারই বান্দরবান থেকে ফেরার সময় কিছুক্ষণ একভাবে ব'সে থাকার পর মনে হয় হাঁটু, কোমর, কনুইসহ শরীরের ভাঁজগুলো লক হয়ে গেছে! জোর ক'রে সোজা করতে গেলে কষ্ট হয়। শরীরের এই ব্যথা থাকে বেশ কয়েকদিন। ব্যথা উপেক্ষা ক'রে রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে পা বাড়ালাম গেটের দিকে। এখন ব্যাগ থেকে চাবি বের ক'রে তালাটা খুলতেও যেমনি আলস্য, তেমনি কষ্ট। এরশাদুলকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলাম ওর ঘরের দরজায় তালা দেখে, বোধহয়, ঈদে বাড়ি গেছে। অগত্যা নিজেই ব্যাগ থেকে চাবিটা বের ক'রে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আবার তালা লাগিয়ে দিলাম। সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ উঠতে বেশ ধকল যাচ্ছে হাঁটু আর কোমরের ওপর দিয়ে। দরজার সামনে গিয়ে বেল বাজালাম। পায়ে এখনো রুমাবাজার থেকে কেনা সেই প্লাস্টিকের স্যান্ডেলটাই রয়েছে, খুলে ফেললাম। দরজা খুলে দিলেন বাবা, আমি কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে সবে ঘরের ভেতরে এক পা এগিয়েছি, অমনি বাবা ঠাস ক'রে আমার বাম গালে এক চড় কষে প্রায় চিৎকার ক'রে বললেন, 'তোর মোবাইল বন্ধ কেন?'

পর মুহূর্তেই দু'হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধ'রে অবোধ শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন! কয়েক মুহূর্তের জন্য আমাকে বুক থেকে ছাড়িয়ে আমার কপালে-গালে পাগলের মতো চুমু খেয়ে আবারও বুকে জড়িয়ে ধরলেন! আমি বাবার বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে আছি, মা ছুটে এসে বাবাসহ আমাকে জড়িয়ে ধ'রে কাঁদতে লাগলেন; আমার মাথার চুলে আদর বোলাতে লাগলেন।

ঘটনার আকর্ষিকতায় আমি হতবাক! হচ্ছেটা কী! প্রথমে খেলাম বাবার হাতের চড়, তারপর বাবা-মা উভয়ের বাঁধভাঙা আদরে আর চোখের পানিতে সিক্ত হচ্ছি! আমি ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবা-মা কি এমন কোনো দুঃসংবাদ পেয়েছে যে, আমি ম'রে গেছি? কিংবা বান্দরবানে হয়তো কোনো বাস দুর্ঘটনায় পর্যটক মারা গেছে, আর বাবা-মা আমাকে ফোনে না পেয়ে ধ'রে নিয়েছে যে, ওই দুর্ঘটনায় আমার কিছু হয়েছে? ঘটনা যাই-ই হোক, আমি নিশ্চিত, তাঁরা আমাকে বারবার ফোন করেছেন আর ফোন বন্ধ পেয়ে উত্তরোত্তর তাদের টেনশন বেড়েছে। বান্দরবানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে থাকলেও আমি সে খবর জানি না, এই পাঁচদিন বাকি পৃথিবীর কোনো খবরই আমি নিইনি। নৌ-পথে রুমাবাজার যাবার সময়ই আমি ফোনের ইনকামিং কল বন্ধ রেখেছিলাম, বান্দরবান এসে ফেরার বাসে উঠেও ইনকামিং কল চালু করার কথা মনে ছিলো না।

ঘটনা জানার কৌতূহলের চেয়ে আমার মন বুঁদ হয়ে আছে বাবা-মায়ের আদরে। কতোদিন আমি এভাবে বাবা-মায়ের আদর পাই না, কতোদিন আমি বাবা-মায়ের গায়ের চেনা গন্ধ এমন নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারি না, কতোদিন আমার চুলগুলো মায়ের হাতের স্পর্শ পায় না! এক বাড়িতে থেকেও বিগত চার বছর আমি তাদের কাছে দূরের মানুষ হয়ে আছি, আমি আর তাদের কাছে আগের মতো আদুরে আবদার করতে পারি না, দুষ্টমি করতে পারি না, তাদের অনাদরে এই চার বছরে আমি যেন বড় বেশি পরিণত আর কিছুটা রুক্ষও হয়ে গেছি! চার বছর পর আজ তাদের আকস্মিক অপ্রত্যাশিত স্নেহ-ভালবাসা, আদর, গন্ধ-স্পর্শ পেয়ে আমার চোখে পানি এসে গেছে। চার বছর বঞ্চিত থাকার পর আজ সুযোগ পেয়ে আমিও তাদেরকে আঁকড়ে ধরেছি, যেমনি ছেলেবেলায় ধরতাম। চার বছর পর আমি আবার আমার সেই আগের বাবা-মাকে ফিরে পেয়েছি!

এই অনাকাঙ্খিত ভালবাসায় ভিজতে ভিজতে হঠাৎ আমি বেশ বিব্রতবোধ করলাম বাবার কথা শুনে, 'ভুল বুঝে তোরে আমরা অনেক বকাঝকা করছি, তোর ওপর অনেক অন্যায় আচরণ করছি, তুই সেসব মনে রাখিসনে, বাবা।'

বাবা আমায় ছেড়ে দিয়েছে, আমার ডানহাত মায়ের কাঁধে আর বাঁ-হাত বাবা ধ'রে আছে। আমি চোখের জল মুছে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, 'কী বলছো, বাবা, এসব? কী হয়েছে বল তো?'

ছোট আপু আগেই এসে ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়েছিল, দাদী দরজার কাছে এসে বললো, 'পোলাডা আইলো জার্নি কইরা, ওরে বইতে না দিয়া খাড়া করাইয়া রাখছো তোমরা।'

এবার আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, 'মা, কী হয়েছে, বলো না?'

'যা, গোসল ক'রে খেয়ে-দেয়ে নে, পরে শুনিস।'

'না, আগে বলো, কী হয়েছে? প্লিজ। বাবা, বলো না?'

আমার কাঁধে হাত রেখে বাবা বললেন, 'ফাহাদ আর নাই!'

ফাহাদ আর নেই! মানে ফাহাদ মারা গেছে! আমার চাচার একমাত্র ছেলে, ধর্মের প্রতি অনাস্থার কারণে ও আমার ওপর বিরক্ত হলেও আমি ওকে আপন ভাইয়ের মতোই স্নেহ করি; অথচ বাবা বলছেন ফাহাদ আর নেই! মা আমার বুকে মাথা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। আমার পা কাঁপছে, তবু ডানহাতে মাকে জাপটে ধ'রে বললাম, 'কীভাবে হলো, বাবা?'

'র‌্যাবের গুলিতে!'

'মানে! কী বলছো! ও না চিল্লায় গেছে!'

'ও চিল্লায় যায়নি, জঙ্গিদের দলে ভিড়েছিল। র‌্যাব অভিযান চালিয়েছিল ওদের ডেরায়।'

আমি হাঁ হয়ে গেলাম শুনে! যদিও এটা অস্বাভাকিক কিছু নয়; কেননা খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের মতো ধর্মান্ধ পরিবারের সন্তানদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায় ধর্মীয় অনুশাসন, যারা খুব ছোট থেকেই অমুসলিমদের কাফের-বিধর্মী ভাবে আর তাদেরকে ঘৃণা করতে শেখে, একটু বড় হ'লে কোরান-হাদিস প'ড়ে যারা জানতে পারে যে, মুসলমানদের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করা এবং বিধর্মীদেরকে হত্যা করা ফরজ, জিহাদের সময় প্রাণ গেলে বেহেশ্ত নিশ্চিত; ফলে আমাদের মতো পরিবারের সন্তানেরা খুব সহজেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে।

আমার চোখে এখন ভাসছে চাচার অসহায় মুখটি; যিনি আমাদের পরিবারের ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষটি কঠোরভাবে আগলে রেখেছেন, লালন-পালন করেছেন, বিস্তার লাভ করতে প্রয়োজনীয় সার-ওষুধ দিয়েছেন; আর তারই ধারাবাহিকতায় আজ তার একমাত্র পুত্রের অকাল প্রয়াণ হলো। জানি না, এতে তিনি ব্যথিত নাকি গর্বিত।

মা এখন আমাকে জড়িয়ে ধ'রে কবে কীভাবে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, তার জন্য অনুশোচনা করছে - রোজার মাসে আমাকে খাবার কষ্ট দিয়েছে, আমার একার জন্য ভাল কিছু রান্না ক'রে দেয়নি; এইসব। ফাহাদ নিজের জীবন দিয়ে আমার বাবা-মায়ের চোখের পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে গেল, বাবা-মায়ের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে স'রে যাওয়া আমাকে পুনরায় তাদের হৃদয়ে বসিয়ে দিয়ে গেল। চার বছর আগে আমজাদ ওসামা থেকে যে সবুজ সমতলের জন্ম হয়েছিল, বাবা-মায়ের ভালবাসায় আজ তা শতভাগ পূর্ণতা পেল। জন্মান্তরবাদের চক্র মৃত্যুর পরে নয়, এই মানবজীবনেই বারবার আবর্তিত হয়; প্রচেষ্টা থাকলে ভুলভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলে মানুষ এক জীবনেই বারবার জন্মাতে পারে। বিজ্ঞানের আলোয় অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এখন সময় নবজন্মের। বাবা-মায়ের স্বীকৃতি পেলে নবজন্ম অধিকতর সুন্দর আর শান্তিময় হয়ে উঠতে পারে। আজকের বাবা-মা তারুণ্যের নবজন্মকে স্বীকৃতি দিলে আগামীর বাবা-মা অনেক কাল আগে আরব মরুভূমিতে সৃষ্ট সৃজন, মনন, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা তথা মানব ধ্বংসকারী রক্তলোলুপ মরুঝড় - সাইমুম - রুখবেই, তাদের সন্তানকে সাইমুম থেকে রক্ষা করবেই। সেদিন কেবল বিচ্ছিন্নভাবে একজন-দু'জনের নয়, জন্মান্তর হবে গোটা জাতির।

(সমাপ্ত)

উৎসর্গ

মুক্তমনা অগ্রজ এবং অনুজপ্রতিম কলমযোদ্ধাদেরকে - যাঁরা সত্য প্রকাশের জন্য, সমাজের কুসংস্কার দূর ক'রে এক মানববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন ক'রে কলমযুদ্ধ চালানোর কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক বিদেশে নির্বাসিত হয়েছেন, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, ইসলামী মৌলবাদীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন -

কবি দাউদ হায়দার

তসলিমা নাসরিন

শামসুজ্জোহা মানিক 

রাজিব হায়দার

অভিজিৎ রায়

অনন্ত বিজয় দাস

নিলয় নীল

এবং 

ওয়াশিকুর রহমান বাবু


নিবেদন

সাইমুম-এর মতো একটি উপন্যাস লেখা কেবল আমার জন্যই নয়, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো ভাষার লেখকের জন্যই একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেননা পৃথিবীতে এখন ১৬০ কোটি মুসলমান, এদের অস্তিত্ব এবং প্রভাব কোনোভাবেই অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ইসলামের আবির্ভাব, দর্শন, বিশ্বব্যাপী বিস্তার; সর্বোপরি ইসলামের ইতিহাসের প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে গেলে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের বিশ্বাসের মর্মমূলে আঘাত লাগবেই। মুসলমানরা যেখানে তাদের ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ সমালোচনাই সহ্য করতে পারে না, সেখানে এমন রূঢ় সত্য যে তারা সহ্য করবে না, সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। ফলে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে ব'সে যে কেউ ইসলাম সম্পর্কে সত্য কথা লিখলে বিপুল সংখ্যক মুসলমানের ঘৃণা জুটবে, মানসিক এবং শারীরিক নিপীড়ন সইতে হবে, এটা নিশ্চিত। আর অতীত অভিজ্ঞতায় জানি যে, বাংলাদেশে ব'সে ইসলামের বিরুদ্ধে লেখা মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুর সাথে ছেলেখেলা করা! তারপরও আমি সাইমুম কেন লিখলাম? লিখলাম বিবেকের তাড়নায়; গত চোদ্দশো বছর ধ'রে আল্লাহ্ ও ইসলামের নামে মানবজাতির ওপর মুসলমানদের অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। জানি এতে ক'রে নিজের জীবনে সংকট এবং সংঘাত ডেকে আনলাম, জীবন বিপন্ন করলাম; কিন্তু সাইমুম লিখতে পেরে আমি দারুণ মানসিক শান্তি পাচ্ছি। একজন লেখকের জীবনে অগণিত পাঠকের গালভরা প্রশংসা, তুমুল জনপ্রিয়তা, লক্ষ লক্ষ টাকা রয়্যালিটি, দেশি-বিদেশী রাশভারী পদক; এসবের চেয়ে এই মানসিক শান্তিটুকুর মূল্য অনেক বেশি এবং প্রয়োজনীয়; লেখক হিসেবে আমি অন্তত তাই মনে করি। সত্যকে পাশ কাটিয়ে, সমাজের নানান জাতি-গোষ্ঠী এবং শ্রেণীর অন্ধ বিশ্বাসে আঘাত না দিয়ে, তাদের মন যুগিয়ে লিখে লেখক হিসেবে যেমনি দ্রুত নাম করা যায়, তেমনি প্রচলিত স্রোতে ভাসিয়ে জীবনটা সবরকমভাবে উপভোগও করা যায়; চাইলে হয়তো আমিও তা পারতাম, কিন্তু তাহলে নিজের কাছে আমি কোনোদিনই মানুষ হয়ে উঠতাম না। এখন হয়তো অনেকেই আমাকে ঘৃণা করবে, গালমন্দ করবে, কেউ কেউ অমানুষও বলতে পারে; তাতে আমার কিছু যায়-আসে না, কেননা আমি তো নিজের কাছে মানুষ হতে পেরেছি, অকপটভাবে সত্য বলার জন্য নিজেকে ভালবাসতে পেরেছি। নিজের কাছে নিজে মানুষ হওয়া এবং নিজেকে নিজে ভালবাসতে পারাই এই মানবজীবনে আমার শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনটুকু সারা জীবন ধরে রাখতে চাই, এই অর্জনটুকু নিয়েই বাকি জীবন বাঁচতে চাই। গত ছয়মাস যাবৎ যেসকল পাঠক আমার লেখা প'ড়ে আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মুক্তচিন্তার জয় হোক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন