আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৭

চিঠি-হুমকি - ৩: সম্রাট হিরাক্লিয়াস এর প্রতি - প্রেক্ষাপট!: কুরানে বিগ্যান (পর্ব-১৬৪): ত্রাস, হত্যা ও হামলার আদেশ – একশত আটত্রিশ

লিখেছেন গোলাপ

(আগের পর্বগুলোর সূচী এখানে)

"যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।"

পারস্য সম্রাট খসরু কিংবা তাঁর কোন পরিষদবর্গ স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে কোনোরূপ তর্ক-বিতর্কে, বাদ-প্রতিবাদে বা বিবাদ-বিসংবাদে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও, তাঁরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের ধর্ম প্রচার ও প্রসারে কোনোরূপ বিরূপ প্ররোচনা বা বাধা-নিষেধ প্রয়োগ না করা সত্ত্বেও মুহাম্মদ তার কাছে যে চিঠি-হুমকি প্রেরণ করেছিলেন (পর্ব-১৬২), তারই প্রতিক্রিয়ায় সম্রাট খসরু তার অধীনস্থ ইয়ামেনের গভর্নর বাধানের কাছে যে-নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন, তা কার্যকর করার আগেই কীভাবে কে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন; অতঃপর বাধান কীভাবে মুহাম্মদের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন, তার আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।

মুহাম্মদের পরবর্তী চিঠি-হুমকিটি ছিলো বাইজেনটাইন (পূর্ব রোমান) সম্রাট হিরাক্লিয়াস এর কাছে। মুহাম্মদের এই চিঠিটির বিস্তারিত ও প্রাণবন্ত উপাখ্যান মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ সাল), ইমাম বুখারী (৮১০-৮৭০ সাল), ইমাম মুসলিম (৮২১-৮৭৫ সাল), ইমাম তিরমিজী (৮২৪ -৮৯২ সাল) প্রমুখ আদি ও বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকরা তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।

ইসলাম বিশ্বাসীদের কাছে মুহাম্মদের এই চিঠিটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য যে কত বিশাল, তা আমরা অতি সহজেই অনুধাবন করতে পারি যখন আমরা দেখতে পাই যে, ইসলাম-বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা তাদের বিভিন্ন সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ওয়াজ-মাহফিল ও বক্তৃতা বিবৃতিতে, ইন্টারনেটে আর্টিকেল ও ব্লগগুলোতে, খবরের কাগজে, স্কুল ও মাদ্রাসার পাঠ্য পুস্তকে, রেডিও-টেলিভিশনে ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠান, টক শো ও ক্যাসেট-ভিডিও-ইউটিউব - ইত্যাদি বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমেগুলোতে মুহাম্মদের এই চিঠির বিষয়টি বিশেষভাবে উদ্ধৃত করে যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, তা হলো,

"মুহাম্মদ যে সত্যই আল্লাহর প্রেরিত শেষ নবী তা খ্রিষ্টান বাইজেনটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস (ও আবিসিনিয়ায় সম্রাট নাজ্জাসী) স্বয়ং নিশ্চিত করেছেন ----!”

সুতরাং, নিঃসন্দেহে ইসলাম বিশ্বাসীদের কাছে হিরাক্লিয়াস-কে লেখা মুহাম্মদের এই চিঠিটি ইসলামের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সে কারণেই আদি উৎসের বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদেরই লিখিত সিরাত ও হাদিস গ্রন্থের বর্ণনার আলোকে এ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যালোচনা আগামী কয়েকটি পর্বে করা হবে।

"মহাকালের পরিক্রমায় এক নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের ইতিহাস হলো সেই নির্দিষ্ট স্থান ও কালের পারিপার্শ্বিক অসংখ্য ধারাবাহিক ঘটনাপরম্পরা ও কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। ঘটনাপরম্পরার এই ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করে কোনো বিশেষ সময়ের ইতিহাসের স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়! বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ (পর্ব-১১১)" সে কারণেই ইসলামের ইতিহাসের মুহাম্মদের এই সব চিঠি-হুমকি বিষয়ের ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যালোচনা শুরু করার পূর্বে মুহাম্মদের সমসাময়িক পৃথিবীর অন্যান্য সংশ্লিষ্ট (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) ঘটনা প্রবাহের আলোচনা আবশ্যক। The Devil is in the Detail (পর্ব-১১৩)!

অতি সংক্ষেপ:

হুদাইবিয়া সন্ধির সময়কালে মুহাম্মদ যে পারস্য (সাসানিদ) সম্রাটের কাছে চিঠি লিখেছিলেন, তিনি ছিলেন সম্রাট প্রথম খসরুর (শাসনকাল ৫৩১-৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ) নাতি দ্বিতীয় খসরু, নাম পারভেজ (শাসনকাল ৫৯০-৬২৮ সাল)

৫৯০ সাল:
দ্বিতীয় খসরুর (খসরু পারভেজ) পিতা ছিলেন পারস্য সম্রাট চতুর্থ হরমুজিদ (Hormizd IV), শাসনকাল ৫৭৯-৫৯০ খ্রিষ্টাব্দ। পিতা চতুর্থ হরমুজিদের খুন হওয়ার পর বাইজেনটাইন সম্রাট মরিস (শাসনকাল ৫৮২-৬০২ সাল) এর সাহায্যে খসরু পারভেজ সাসানিদ (পারস্য) সাম্রাজ্যের পরবর্তী শাসনকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হন ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে। অতঃপর, সম্রাট মরিসের শাসনের পরিসমাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত বাইজেনটাইনদের সঙ্গে সাসানিদদের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ।

৬০২ সাল: 
এক সামরিক ক্যু'র মাধ্যমে সম্রাট মরিস-কে (৫৩৯-৬০২ সাল) হত্যা করে ৬০২ সালে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের শাসনভার দখল করেন সম্রাট 'ফোকাস (Phocas)'। এই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের নিমিত্তে ফোকাসের বিরুদ্ধে সম্রাট খসরু পারভেজ যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নতুন করে শুরু হয় বাইজেনটাইন সম্রাটদের সঙ্গে সাসানিদদের একের পর এক যুদ্ধবিগ্রহ, যা ৬২৮ সালে খসরু পারভেজের মৃত্যুকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।  

৬১০ সাল: 
সম্রাট 'ফোকাস'-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাকে হত্যা করে হিরাক্লিয়াস ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের শাসনভার দখল করেন। ক্ষমতা দখলের পর হিরাক্লিয়াস সাসানিদদের সঙ্গে যুদ্ধ-বন্ধ ও সন্ধির উদ্দেশ্যে সম্রাট খসরুর দরবারে তার কিছু প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। কিন্তু খসরু তার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ও বলেন,

"ঐ সাম্রাজ্যের মালিক হলাম আমি, আমি মরিস পুত্র থিওডোসিয়াস-কে (Theodosius) তার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করাবো। সে (হিরাক্লিয়াস) আমাদের হুকুম ছাড়া ক্ষমতা দখল করে এখন আমাদেরকে আমাদেরই সম্পদ উপহার দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি তাকে আমার নাগালের কাছে পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত থামবো না।"

অতঃপর খসরু হিরাক্লিয়াসের পাঠানো প্রতিনিধিদের হত্যা করেন। 

৬১৩ সাল: 
৬০৮ থেকে ৬১৩ সাল সময়ের মধ্যে সাসানিদরা একের পর এক দখল করে নেন বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের অধীনস্থ দারা (Dara), আমিদা (Amida), এডিসা (Edesa), হিরাপোলিস (Hierapolis), আলেপ্পো (Aleppo), আপামিয়া (Apamea), সিসারিয়া (Caesarea), দামেস্ক (Damascus) ও আশেপাশের অন্যান্য সমস্ত শহরগুলো।

৬১৪ সাল:
সম্রাট খসরু তার শারবারায (Shahrbaraz) নামের এক জেনারেলের নেতৃত্বে দামেস্ক ও জেরুজালেম অবরোধ ও দখল করেন। অতঃপর তিনি সেখানকার খ্রিষ্টানদের ওপর চালান হত্যা যজ্ঞ, তাদের গির্জাগুলো দেন পুড়িয়ে, ভূলুণ্ঠিত করেন তাদের ধর্মীয় প্রতীক বিশুদ্ধ-ক্রস (True Cross) ও তা নিয়ে আসেন পারস্যে।

৬১৬ সাল:
সাসানিদরা মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেন ৬১৬ সালে ও ৬১৯ সালের মধ্যে তারা সমগ্র মিশর (ইথিওপিয়ার সীমানা পর্যন্ত) দখল করে নেন।

৬২২-৬২৩ সাল: 
সাসানিদরা রোদিস (Rhodes) দ্বীপ ও পূর্ব এজিয়ান সমুদ্রে (Aegean Sea) অবস্থিত অন্যান্য দ্বীপগুলো দখল করে নেন ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল শহরের (বর্তমান ইস্তাম্বুল) ওপর হামলার হুমকি প্রদান করেন। হিরাক্লিয়াস এর অবস্থা এতটায় বেগতিক হয়ে ওঠে যে তিনি তার শাসন কার্যালয় গুলো কনস্টান্টিনোপল থেকে সড়িয়ে আফ্রিকার কার্থেজ ('Carthage'- যার অবস্থান ছিলো বর্তমান তিউনিসিয়ার লেক তিউনিস এর পূর্ব প্রান্তে) শহরে স্থানান্তর করার চিন্তাভাবনা করেন।  

এতকিছুর পরও সাসানিদরা বাইজেনটাইনদের সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করতে পারেননি। সম্রাট 'ফোকাস'-কে হত্যা করে ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার দশ বছর পর সম্রাট হিরাক্লিয়াস (শাসনকাল ৬১০-৬৪১ সাল) নতুন করে সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠন ও সামরিক শক্তি অর্জন করতে সমর্থ হন। যদিও ৬২২ সালে সাসানিদরা এজিয়ান সমুদ্র ও তার দ্বীপগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করেছিলো, তাদেরকে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে হিরাক্লিয়াস এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

৬২৪ সাল:
৬২৪ সালে হিরাক্লিয়াস পারস্যের উত্তর আদুরবাদাগান (Adurbadagan) প্রদেশ (বর্তমান ইরানের আজারবাইজান প্রদেশ) অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে তিনি খসরু শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ফারুক হুরমুযিদ (Farrukh Hormizd) ও রুস্তুম ফারুকযাদ (Rostam Farrokhzad) এর দ্বারা আমন্ত্রিত হন। হিরাক্লিয়াস সেখানকার বেশ কিছু শহর ও মন্দির দখল করেন। 

এই একই বছর তিনি এক শক্তিশালী বাহিনী সমুদ্রপথে কৃষ্ণ সাগরের (black sea) ভেতর দিয়ে যাত্রা করান, তারা আরমানিয়ান অঞ্চলে অবতরণ করে। অতঃপর তারা পেছন দিক থেকে পারস্যের ওপর হামলা চালান, ইতিহাসে যা 'বাইজেনটাইনের ক্রুসেড  (Byzantine Crusade)' নামে আখ্যায়িত। সাসানিদ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেহেতু এনাটোলিয়া (বর্তমান তুরস্ক) থেকে মিশর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিলো, এই অপ্রত্যাশিত হামলা মোকাবিলা করার  প্রস্তুতি তাদের ছিলো না। হিরাক্লিয়াসের এই হামলাটি সাসানিদদের বিরুদ্ধে তার সামরিক বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে।  

৬২৬ সাল:
পরিশেষে সাসানিদরা ৬২৬ সালে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) শহরটি অবরোধ করে, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে স্লাভ ('Slav' -মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অধিবাসী) ও আভার ('Avar' - কাসপিয়ান ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলের [ককেশিয়ান] অধিবাসী) সৈন্যরা। তাদের এই অবরোধ' প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়। 

৬২৭ সাল - ৬২৮ সাল:
৬২৭ সালের তৃতীয় পারস্য-তুর্কী যুদ্ধের (Perso-Turkic War) পর, হিরাক্লিয়াস 'নিনেভা যুদ্ধে (Battle of Nineveh)' সাসানিদদের পরাজিত করেন। অতঃপর হিরাক্লিয়াস তাদের বিরুদ্ধে পালটা আক্রমণ (counterattack) শুরু করেন ও একের পর এক খসরু পারভেজের অধিকৃত অঞ্চলগুলো পুনর্দখল করেন। তিনি পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের (Eastern Mediterranean) বিস্তীর্ণ এলাকাগুলো ('Levant'), এনাটোলিয়ার ('Anatolia' - বর্তমান তুরস্ক) অধিকাংশ অঞ্চল, কৃষ্ণ সাগর ও কাসপিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল ('Caucasus") ও মিশর বিজয় সমাপ্ত করেন।

হিরাক্লিয়াস পরাস্ত করেন আরমেনিয়া (সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী 'ককেশিয়া' [Caucasus] অঞ্চল) অঞ্চলের খসরু সেনাবাহিনীদের, আর অন্যদিকে তার ভাই থিওডোরাস (Theodorus) পরাস্ত করেন পশ্চিম অঞ্চলে খসরুর দ্বিতীয় সেনাবাহিনীদের। সাসানিদ, স্লাভ ও আভার সম্মিলিত বাহিনীর 'কনস্ট্যান্টিনোপোল অবরোধ' প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়। পরাজিত সাসানিদরা ৬২৮ সালের শেষ দিকে এনাটোলিয়া থেকে তাদের সৈন্যবাহিনী ফিরিয়ে নেন। 

পরিশেষে হিরাক্লিয়াস টাইগ্রিস নদীর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত সাসানিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী টেসিফোন শহর আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন ('Ctesiphon' - যার অবস্থান ছিল বর্তমান বাগদাদ শহর থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে)। সম্রাট খসরু পারভেজ তাকে কোনোরূপ বাধা প্রদানের চেষ্টা ছাড়াই টেসিফোনের নিকটবর্তী তার প্রিয় দাস্তাগার্ড (Dastagird) রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যান। হিরাক্লিয়াস দাস্তাগার্ড দখল ও লুট করেন। তিনি তাদের ধর্মীয় প্রতীক 'বিশুদ্ধ ক্রস' (True Cross) পুনরুদ্ধার করেন। যেহেতু খসরু জেরুজালেম অপবিত্র করেছিলেন, তাই তিনি তাদের পবিত্র ভূমি ক্লোরামিয়া (Clorumia), জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান, ধ্বংস করেন ও সেখানে অবস্থিত তাদের পবিত্র অগ্নিশিখা নির্বাপিত করেন।

সম্রাট হিরাক্লিয়াস কর্তৃক দাস্তাগার্ড দখল হওয়ার পর, ৬২৮ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় খসরু পুত্র দ্বিতীয় কাবাদ  (Kavadh II ) তার পিতাকে বন্দী করেন ও নিজেকে সাসানিদ সাম্রাজ্যের পরবর্তী শাসক হিসাবে ঘোষণা দেন। একই সাথে তিনি তার পিতার অতি আদরের সন্তান মদনশাহ (Mardanshah) সহ তার সকল ভাই ও সৎ ভাইদের হত্যা করার জন্য পিরোজ খসরু (Piruz Khosrow) নামের এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন। এই ঘটনার তিন দিন পর কাবাদ তার পিতাকে হত্যা করার জন্য মিহির হরমুজিদ (Mihr Hormozd) নামের এক লোককে আদেশ করেন (পর্ব-১৬৩)। কোনো কোনো সূত্রে বলা হয় যে, তিনি তার পিতাকে তীরবিদ্ধ করে তিলে তিলে হত্যা করেছিলেন।

অতঃপর কাবাদ পারস্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় বাইজেনটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাইজেনটাইনরা পুনরুদ্ধার করে তাদের সকল অঞ্চল, মুক্ত করে তাদের সকল বন্দী সেনাদের, আদায় করে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও পুনরুদ্ধার করে তাদের ধর্মীয় 'বিশুদ্ধ ক্রস' ও অন্যান্য পবিত্র স্মরণ-চিহ্ন, যা তারা ৬১৪ সালে হারিয়েছিল জেরুজালেমে। অতঃপর হিরাক্লিয়াস বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন কনস্টান্টিনোপল। আর অন্যদিকে সাসানিদ সাম্রাজ্যের যে মহিমা ও অর্জন দশ বছর আগে পৌঁছেছিল, তা তলিয়ে যায় নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলায়।

এটিই ছিল বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য (৩৩০-১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) ও সাসানিদ সাম্রাজ্যের (২২৪ - ৬৫১ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধ। তাদের মধ্যে এতগুলো বছরের বহুসংখ্যক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অসংখ্য হতাহতের বিনিময়ে কোনো পক্ষই লাভবান হতে পারেনি। যুদ্ধে উভয় পক্ষই এতটায় দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, ভবিষ্যতের আগ্রাসী আরব শক্তির মোকাবিলা করার সামর্থ্য তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন।  

অন্যদিকে, মুহাম্মদের নেতৃত্বে “আগ্রাসী আরব শক্তির” দ্রুত উত্থান:

>> মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ মদিনায় হিজরত করেন সেপ্টেম্বর ২৪, ৬২২ সালে (পর্ব-২৮)। অতঃপর তিনি তাঁর অনুসারীদের সহায়তায় "ধর্মের নামে" এক  শক্তিশালী আগ্রাসী বাহিনী গঠন করেন। তাদের সেই আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত 'ত্রাস, হত্যা ও হামলার আদেশ' শিরোনামে গত একশত সাঁইত্রিশটি পর্বে করা হয়েছে। ৬২২ সাল থেকে ৬২৮ সাল পর্যন্ত যখন বাইজেনটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ একে অপরের বিরুদ্ধে প্রাণান্তকর লড়াইয়ে ক্রমান্বয়ে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করে চলেছেন, মুহাম্মদের নেতৃত্বে 'আগ্রাসী আরব শক্তির' শক্তিমত্তা গত ছয়টি বছরে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মুহাম্মদ এখন এই দুই সাম্রাজ্যের অধিপতিদের ও 'চিঠি-হুমকি দেয়ার ক্ষমতা রাখেন!

প্রশ্ন হলো,
"ধর্মের নামে" মুহাম্মদের এই যে সামরিক শক্তির উত্থান, সে বিষয়ে কী বাইজেনটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস, পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ, আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) শাসক নাদজাসি (নাজ্জাসী), আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা আল-মুকাওকিস - অর্থাৎ মুহাম্মদ তাঁর সমসাময়িক ও চারিপাশের অবিশ্বাসী শাসকদের কাছে যে সমস্ত চিঠি-হুমকি পাঠিয়েছিলেন (পর্ব-১৬১), তাদের কেউই মুহাম্মদের নেতৃত্বে এই নব্য আগ্রাসী আরব সামরিক শক্তির উত্থান বিষয়ে কোনোকিছুই জানতেন না, এমন সম্ভাবনা কতটুকু? 

মক্কা-মদিনা থেকে সামান্য দূরে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী বর্তমান ইস্তাম্বুলে বসবাসকারী সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও তার সামরিক জান্তা ও উপদেষ্টারা, বাগদাদের অতি নিকটে সাসানিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী 'টেসিফোন' শহরে বসবাসকারী সম্রাট খসরু পারভেজ ও তার সামরিক জান্তা ও উপদেষ্টারা, পাশেই মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার বসবাসকারী আল-মুকাওকিস ও তার পরিষদবর্গ, একটু দুরেই বর্তমান ইথিওপিয়ায় বসবাসকারী রাজা নাজ্জাসী এদের কেউই গত ছয়টি বছরে (৬২২-৬২৮) মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা সংঘটিত বদর যুদ্ধ ও তার ফলাফল (পর্ব: ৩০-৪৩),  ওহুদ যুদ্ধ (পর্ব: ৫৪-৭১),  খন্দক যুদ্ধ (পর্ব: ৭৭-৮৬), অতঃপর বনি কুরাইজার নৃশংস গণহত্যা (পর্ব: ৮৭- ৯৫), কিংবা খায়বার যুদ্ধ ও তার ফলাফল (পর্ব: ১৩০-১৫২), অতঃপর ফাদাক আগ্রাসন (পর্ব: ১৫৩- ১৫৮) - ইত্যাদি লড়াই ও সংঘর্ষের বিষয়ে তারা কোনো খোঁজ খবরই রাখতেন না, এমন যুক্তি কতটুকু গ্রহণযোগ্য? 

হিরাক্লিয়াস, খসরু, নাদজাসি, আল-মুকাওকিস প্রমুখ শাসকদের এতটা 'গবেট' ভাবার কোন কারণ আছে কি?

(চলবে)

তথ্যসূত্র ও পাদটীকা: 

[1] কৃতজ্ঞতা - ইন্টারনেট আর্টিক্যাল:

Sassanids vs Byzantines

Chronology of Iranian History Part

Timeline of the Sasanian Empire

Khosrow II

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন