আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১০

পী লে, পী লে, ‘মেরী’ নাম কা পেয়ালা...

লিখেছেন কৌস্তুভ 

শচীনকত্তার ওই ভক্তিমূলক হিন্দি গানখানা হয়ত অনেকেই শুনেছেন। না শুনলে শুনতে পারেন। কিন্তু না, এখানে গান নিয়ে আজ আলোচনা করছি না। দুটো কথা বলব, জয়গান নিয়ে। ধম্মকম্মের। আমার পরিপ্রেক্ষিত থেকে। আর সাথে চানাচুর হিসাবে ইতালীয় বালিকার গপ্প। (আসল লেখাটা পড়তে না চাইলে শেষে চলে যান।)

(১)
কয়েকদিন আগে আমাদের ইউনির মেডিকাল স্কুলে ক্যাথলিক স্টুডেন্ট গ্রুপ এক বক্তৃতার আয়োজন করেছিল। তার হেডিং পড়েছিল, “মিরাক্‌ল্‌ আরোগ্য? লুর্দ গির্জায় চিকিৎসাবিজ্ঞান-নির্ভর অনুসন্ধান”। এবং তলায় লেখা, যাঁরাই এই একবিংশ শতাব্দীতে ধর্ম ও বিজ্ঞানের ‘ডায়নামিক ইন্টারপ্লে’ দেখতে আগ্রহী, তাঁরা অবশ্যই আসুন।

বিজ্ঞানের পক্ষে বক্তৃতাটি ঝুঁকে, নাকি ধর্মের পক্ষে, সে সম্পর্কে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি পোস্টারটিতে। মেডিকাল স্কুল যখন, তখন মিরাক্‌ল্‌ আরোগ্যের কোনো দাবিকে অপ্রমাণ করা হবে, এটা মনে হচ্ছিল। আবার ভাবছিলাম, ক্যাথলিক ছাত্রদের আয়োজিত যখন, তখন প্রমাণের চেষ্টাও বিচিত্র নয়। হয়ত একটা সমঝোতার চেষ্টা করা হবে, ভাবলাম। ‘অ্যাপলজিস্ট’ ধরনের কোনো অবস্থান আর কি।

(২)
গিয়ে জানলাম, বক্তৃতাটি ফ্রান্সের দক্ষিণের লুর্দ শহরের ‘আওয়ার লেডি অফ লুর্দ’ নামক গির্জাটির সম্বন্ধে। সেখানে একটি ‘পবিত্র জলধারা’ আছে, যা একটা চৌবাচ্চায় জমা করা হয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থী সেখানে স্নান করতে আসেন। স্নান মানে, দুজন কর্মী আপনাকে ধরে সেই ৮-৯ ডিগ্রীর ঠাণ্ডা জলে ঘচাং করে ডুবিয়েই তুলে ফেলবে। মানস সরোবরের হিমশীতল জলে ডুব দিয়ে যেমন তনুমনঝাঁঝাঁকরণ চাঙ্গা ভাব হয়, তেমন আর কি। তবে ওখানেই শেষ নয়। এ পর্যন্ত বহু লোকেরই নাকি ওই জলে স্নান করে দুরারোগ্য ব্যাধি সেরে গেছে। প্রায় দেড়শ বছর ধরে এই স্নান চলছে (ওই যেমন হয়, শুরুতে মাতা মেরী এক পরমাসুন্দরী শ্বেতবস্ত্রাবৃতা যুবতীর সাজে কাউকে দর্শন দিয়ে কিছু বাণীটাণী দিয়েছিলেন), এখনও অবধি হাজার হাজার লোকে এই দাবী করেছে।

নিঃসন্দেহ হতে, গির্জার পাদ্রী এক মেডিকাল বোর্ড স্থাপন করেন, তাও বহুদিন হল। তার এক হেড-ডাক্তার আছেন। তিনি এবং অন্যান্যরা মিলে এই দাবীগুলি পরীক্ষা করে রায় দেন, এগুলো সত্যিই চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী সারানো অসম্ভব কি না। তেমন হলে, এই কেসগুলি ক্যাথলিক হর্তাকর্তাদের কাছে যায়, তাঁরা নেড়েচেড়ে রায় দেন, হ্যাঁ এটি একটি মিরাক্‌ল্‌।

এই ইতালীয় ভদ্রলোক সেখানকার বর্তমান হেড-ডাক্তার। প্রথম অ-ফরাসী। হার্ভার্ড মেডিকাল স্কুল থেকেই পাশ। আগে অন্য কোথাও কাজ করতেন, গত বছর ওদের ডাক পেয়ে সেখানে যোগ দেন। নিজেও ক্যাথলিক, ছাত্রজীবনে সেখানে তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন। ইউনির ক্যাথলিক স্টুডেন্ট গ্রুপের কিছু ছাত্র সম্প্রতি সেখানে তীর্থযাত্রায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়, তখন তাঁকে এখানে বক্তৃতা দিতে আহ্বান করে। তিনি সাগ্রহে স্বীকৃত হন। আরো অন্যান্য শহরেও তিনি এই লেকচারটি দেবেন বলে জানালেন।

(৩)
এ পর্যন্ত শুনেই নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, লেকচারটি কী ছিল। একটি বিবরণমূলক বিজ্ঞাপন, যদি ভদ্রতাবশত প্রোপাগান্ডা কথাটি না বলি। স্থানটির মহিমা সম্বন্ধে বিশদ জানালেন, কিভাবে এই ঘটনাগুলি চিহ্নিত হয়, সেখান থেকে মিরাক্‌ল্‌ ঘোষণা হওয়া অবধি পদ্ধতিগুলি কি কি, ইত্যাদি। গর্ব করে বললেন, তাঁরা অত্যন্ত ‘উন্মুক্ত’। ওনার দপ্তরে এসে যে কোনো ডাক্তার কোনো কেসের ফাইলপত্র চাইলেই ওনারা সাগ্রহে দেখাবেন, যাতে ওই ডাক্তারও পরীক্ষা করে নিতে পারেন, সত্যিই দুরারোগ্য কি না। বললেন, এইধরনের আরোগ্যকে আমরা ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাখ্যার অযোগ্য’ বলি না, বলি ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না’। অ্যাকাডেমিক লাইনে কিছু প্রকাশ করতে গেলে যাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয় (অবশ্য এখন সম্মান কমে যাচ্ছে) – সেই ‘পীয়ার রিভিউ’ অর্থাৎ সম পেশার অন্যদের দিয়ে সেগুলিকে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া, তাও তাঁরা করেন বললেন। প্রথম ধাপে তাঁরা নিজেরাই কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। তারপর একটি কমিটি নির্বাচিত করা থাকে, যাতে অনেক প্রতিষ্ঠিত ডাক্তাররা থাকেন, তাদের কাছে সেগুলি পাঠানো হয়। তাঁরা পরীক্ষা করে রায় দেন। তারপর তাদের মধ্যে এটি ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না’ কি না তাই নিয়ে ভোট হয়। ভোটে জিতলে সেটি ধর্মগুরুদের কাছে পাঠানো হয়।

(৪)
এ পর্যন্ত নাকি ৬৭ টি মিরাক্‌ল্‌ চিহ্নিত হয়েছে। তার মধ্যে ক্যানসার, টিবি, আর্থরাইটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস ইত্যাদি আছে। একটা কেসের সামারি ধরালেন লোকজনকে। ছবিটবি আর টাইমলাইন দিয়ে। সেসব ডাক্তারির ব্যাপার আমি কিছু বুঝি না।

এই দাবিগুলির বিষয়ে আমার কয়েকটি বক্তব্য আছে। আপনারা সহমত কি না, ভেবে বলবেন।

১. এই দীর্ঘ দেড়শ বছরে মাত্র ৬৭টি কেস মিরাক্‌ল্‌ হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভুল হবার হার কত? এই আমেরিকার মত আধুনিক ব্যবস্থাসম্পন্ন জায়গাতেও দেশের মতই ভুল পা কেটে বাদ দেওয়া, আসল স্যামের বদলে অন্য স্যামকে ক্যান্সার হয়েছে বলে বলে দেওয়া, অপারেশনের পর পেটে ছুরি রেখে দেওয়া, এ তো কতই হয়। এমন তো হতেই পারে, বায়োপ্সির রিপোর্ট গুলিয়ে ফেলে যাঁকে ক্যান্সার হয়েছে বলে ধরে নিয়ে প্রচুর কেমোথেরাপি দেওয়া হল, সেই ভক্তিমতী মহিলা ওই জলে চান করে প্রচুর জোশ নিয়ে দেশে ফেরত গেলেন, তারপর আশায় আশায় আবার বায়োপ্সি করালেন। ব্যাস, কেল্লা ফতে!

২. আসলে কমিটির যাঁদের দিয়ে রিভিউ করানো হচ্ছে, তাঁরাও কিন্তু প্রচণ্ড ক্যাথলিক। আর মনে ভক্তিভাব থাকলে মানুষ দরজার কাঠের নকশায়ও যিশুকে দেখে, জলাধারের শ্যাওলায় মেরীকে দেখে। আরো কত কি। তাঁদের রিভিউ কতটা নিরপেক্ষ, আর কতটা মিরাক্‌ল্‌ ঘোষণা করানোর ব্যাপারে উৎসাহী, কে বলবে?

৩. একটা দুরারোগ্য রোগ ওখানে গিয়ে সেরে গেছে বলে তা বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। কিন্তু এমন রোগ কোনো কারণে আপনা থেকে সারতে পারে কি না, বা তেমন সারার হার কত, এসব না জানলে তুলনা করা যাবে কি করে? এত লক্ষ লোক যে ক্যান্সার নিয়ে ওখানে যায় প্রতি বছর, তার মধ্যে সারে আর বিজ্ঞাপিত হয় হয়ত মাত্র ১ জনের। আর বাকিদের? তাহলে সাফল্যের হারটা কেমন?

৪. দেড়শ বছর আগে যা স্বাভাবিকভাবে সারা অসম্ভব বলে ধরা হচ্ছিল, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের নজরে কি তা একই রকম অসম্ভব বলে মনে করা হবে? দুর্ঘটনায় আপনার মাথায় চোট লাগল, আপনার মস্ত্বিস্ক আর ঠিকঠাকভাবে সব কাজকর্ম করতে পারে না। আগেকার দিনে মনে করা হত, এ জিনিস আর বদলাবার নয়। কিন্তু এখন ‘ব্রেন প্লাস্টিসিটি’র নতুন তত্ত্ব বলছে, মাথার নিউরনের জাল আপনা থেকেই বদলায়, এবং বড়সড় পুনর্সংযোগও হতে পারে অনেক ক্ষেত্রে।

(৫)
লেকচারের শেষ দিকে উনি বললেন, হে উপস্থিত সন্দেহপ্রবণ ডাক্তারগণ, আমি সরাসরি কিছু বলছি না, কিন্তু এই আর্টিকলটি দেখ, এখানেও বলেছে, ধর্মে মতি থাকলে রোগ তাড়াতাড়ি সারে।

কৌতূহল হল। বাড়ি এসে আর্টিকলটা নামিয়ে পড়লাম। ইতালিরই জনকয় ধর্মপ্রাণ চিকিৎসকের রচিত। পীয়ার-রিভিউ করা জার্নালেই প্রকাশিত। তবে পীয়ার-রিভিউ যে অনেকাংশেই বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো হয়, সে কথায় পরে আসছি। আর্টিকলটা একটু পড়ি।

সেটার শিরোনাম, ‘ধর্মানুভূতির সঙ্গে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগীদের বেঁচে থাকার অ্যাসোসিয়েশন দেখা গেছে’। কোনো পেপারে যখন তথ্য-সংখ্যা ঘেঁটে স্ট্যাটিস্টিকাল কাজকর্ম করা হয়, ‘অ্যাসোসিয়েশন’ শব্দটা দিয়ে বোঝানো হয় ‘স্ট্যাটিস্টিকাল অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘স্ট্যাটিস্টিকাল কোরিলেশন’কে, যার মানে, সরল ভাষায়, একটার সংখ্যা বাড়লে অন্যটারও সংখ্যা বাড়তে দেখা গেছে ডেটা’য়। কোরিলেশনের মোটামুটি বাংলা সমানুপাত।

এই ‘অ্যাসোসিয়েশন’ অনেকভাবেই দেখা যেতে পারে। তাই একে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কয়েকটা উদাহরণ দিই, যেখানে সমানুপাত’এর কোনো মানেই হয় না। ১. আইসক্রিমের বিক্রি বাড়লে জলে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ে। তাহলে কি আইসক্রিম খেলেই...? না, নিশ্চয়ই নয়। গরমে লোকে ঠান্ডা বেশি খায়, অন্যদিকে জলে দাপাদাপিও বেশি করে আরকি। ২. আপনার বয়স ২৫, মাথায় ঘন কালো চুল। বিয়ে করলেন। পঞ্চাশে মাথায় বিশাল ইন্দ্রলুপ্ত। ওই বৌ ব্যাটার জন্যই! নাকি বয়সের জন্য? ভুক্তভোগীরা অবশ্য প্রথমটারই দাবী করবেন...

(৬)
প্রথমটায় গরমকাল, আর দ্বিতীয়টায় বয়স, এগুলো হচ্ছে ‘হেতু’। যে ধরনের স্ট্যাটিস্টিকাল কাজকর্মে এই হেতু বা ‘কজ’ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়, তাকে বলে ‘কজালিটি’। যেমন সিগ্রেট ফুঁকলে তার ধোঁয়ায় যে সত্যিই লাং ক্যান্সার বাড়ে, সেইটা প্রমাণ করা। এই কাজগুলো তুলনায় অনেক কঠিন। আপনি যদি নিজে হাতে একটি পরীক্ষা সেট-আপ করতে পারেন, যাতে অর্ধেক লোক ফুঁকবে, আর অর্ধেক ফুঁকবে না, আর তাদের খাওয়াদাওয়া পরিবেশ সব সমান রাখতে পারেন, তাহলে হিসাব করে বলা সোজা। নইলে এমনি এমনি কিছু ডেটা থেকে ‘কজালিটি’ বার করা খুব কঠিন।

তা এই পেপারটির শিরোনামে তো শুধুমাত্র ‘অ্যাসোসিয়েশন’ বলা হয়েছে, যে ধর্মানুভূতি বেশি এমন লোকেদের বেশিদিন বাঁচতে দেখা গেছে। তাহলে ঐ বক্তা ভদ্রলোক এমন ‘কজালিটি’র দাবী করলেন কেন, যে ওখানে নাকি লেখা, ধর্মানুভূতি থাকলে লোকে বেশিদিন বাঁচবে?

পুরোটা পড়লাম। দেখি, ভেতরে সত্যিই সেই দাবী করা! এক জায়গায় লেখা, তাহলে আমরা এই ‘হাইপোথিসিস’ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম, যে ধর্মানুভূতি সত্যিই বাঁচার হার বাড়ায়। দেখেন কাণ্ড। ‘অ্যাসোসিয়েশন’ থেকে যে লাফ মেরে কজালিটি’তে চলে যাওয়া যায় না, সেটা মানতে এঁদের বয়েই গেছে। আরেক জায়গায় বলছেন, আমরা এইটা বিশ্বাস করতে আগ্রহী, যে ওই যে সম্পর্কটা দেখা গেছে, সেটা শুধুই সমানুপাত নয় বরং হেতু; ধর্মবিশ্বাস রোগীদের জীবনপথের সত্যিই এক বিরাট পাথেয়। তা এমন বিশ্বাস থাকলে আর যুক্তি-বুদ্ধি-অ্যানালিসিসের প্রয়োজন আছে, বলেন?

(৭)
আর সেসব হলে যে অ্যানালিসিস ছেড়াবেড়া হবে, সে তো প্রত্যাশিতই। এনারা স্ট্যাট-এর যে পদ্ধতিটা ব্যবহার করেছেন, তার নাম ‘সারভাইভাল অ্যানালিসিস’। আতিপাতি স্ট্যাট কাজকর্মের চেয়ে এটা একটু বেশি জটিল, তাই অসাবধানে এটা ব্যবহার করলে ভুলও বেশি হয়। একটা উদাহরণ দিই।

মনে করুন, আমরা দেখলাম আপনার ৭০ বছরের বেশি বাঁচার সম্ভাবনা ২০%। তাহলে ৫০ বছরের বেশি বাঁচার সম্ভাবনা তো অন্তত ওই ২০% হবেই। আসলে আরো বেশিই হবে, হয়ত ৪০%। তাই বয়সের তুলনায় বাঁচার হার আঁকলে সেই গ্রাফ কেবল কমবেই।

অথচ, একটা পীয়ার-রিভিউ করা পেপার, যাতে তুলনা করে দেখানো হচ্ছে, যে সাধারণ মানুষের তুলনায় পপ-স্টারদের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাত্রার কারণে মৃত্যুহারও বেশি, সেখানে কিন্তু পপ-স্টারদের সেই গ্রাফ উঠছে-নামছে!

(৮)
এই পেপারেও ওই অ্যানালিসিস লাগাতে গিয়ে যাচ্ছেতাই সব কাণ্ড করেছেন ওঁরা। আমার ব্লগে বিস্তারিত লিখেছিলাম, এখানে সংক্ষেপে বলি।

চিকিৎসার পর বাঁচার হার যখন মাপবেন, তখন লিভার প্রতিস্থাপনের পর কোনো শারীরিক জটিলতায় মৃত্যু হচ্ছে কি না, সেটাই তো মাপবেন। হঠাৎ কেউ এসে আপনাকে গাড়ি চাপা দিল আর আপনি পটল তুললেন, এটা কেন ওই চিকিৎসা-গবেষণার মৃত্যুহারে মাপা হবে? বরং, নিয়ম হল, যেহেতু এভাবে মারা গেলে আপনার প্রকৃত শারীরিক হালচাল আর মাপা যাচ্ছে না, তাই বলা হবে, আপনাকে ‘সেন্সর করা’ হয়েছে। সেন্সর করা আর জটিলতায় মারা যাওয়া দুটোকে আলাদা ভাবে হিসাব করতে হয়। এখানে সব মিশিয়েটিশিয়ে দিয়েছেন ওঁরা। কেন করা হয়েছে, সেটায় পরে আসছি।

৩ বছর ধরে ১৭৯ জন রোগীকে স্টাডি করেছেন ওঁরা – ৮৯ জন ধার্মিক আর ৯০ জন অধার্মিক, তাতে মাত্র ১৮ জন মারা গেছে মোট। এই হারটা খুবই কম। তাই হিসাবে ত্রুটি হবার সম্ভাবনা বেশি। পরে আসছি তাতে। তা এঁরা বলেছেন, কোনো ‘ডেটা লস’ হয় নি, এই ৩ বছর সবাইকেই স্টাডি করতে পেরেছেন (মারা যাওয়া লোকেদের বাদ দিয়ে)। অথচ, ১ বছর পরেই বলছেন, এখন ১২৮ জনকে মাপছি। বাকি ৪৯ জন কই? অত লোক তো মরেও নি। হিসাবের কড়ি বাঘে খেয়ে গেল?

আচ্ছা, হিসাব শুরু করেছিলেন, প্রায় সমান ধার্মিক ও অধার্মিক মানুষ নিয়ে। তাহলে সমান সমান হলে, দুটো গ্রুপেই ৯ জন করে মরার কথা। এবার যদি ধার্মিক গ্রুপে ১ আর অধার্মিক গ্রুপে ২ জন দুর্ঘটনায় মরে থাকেন, তাহলেই তো আসল মৃত্যুহারের অনুপাত বেড়ে ১১৫% হয়ে যায়। হিসাবে গণ্ডগোল, যা দেখাতে চাইবেন তা আসবে না। তাই দে গরুর গা ধুইয়ে, সব ধরনের মরা মিশিয়ে দে।

আসলে, যেসব বিষয়গুলির গবেষণায় স্ট্যাট ব্যবহার করা হয়, যেমন ডাক্তারি, ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি, তাদের পরীক্ষালব্ধ ফলগুলি থেকে কিছু প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করতে, সেখানে স্ট্যাটিস্টিক্স একটা সেকেন্ডারি বিষয়। অন্যান্য সরঞ্জামের মতনই স্ট্যাটকেও একটা ব্যবহার্য সরঞ্জামের মতই ধরা হয়। তাই তাদের স্ট্যাটে যথেষ্ট ট্রেনিং দেওয়া হয় না, এবং তেমন গুরুত্বও দেওয়া হয় না, কোনোরকম করে একটা লাগিয়ে রেজাল্টটা পছন্দমত পেলেই হল। রিভিউয়ের সময়ও অ্যানালিসিসে কোনো ভুল আছে কিনা দেখার জন্য কোনো স্ট্যাটের লোককে রাখা হয় না।

(৯)
পেপারের রেজাল্ট সেকশনে অ্যানালিসিস করে পাওয়া ফলগুলো দিয়ে, ডিসকাশন সেকশনে সেগুলো ব্যাখ্যা করার নিয়ম। এই পেপারে ওনারা সেখানে ফল ব্যাখ্যার বদলে ধর্মকে ব্যাখ্যা করেছেন। গোটা স্টাডিতে কোথাও মাপা হয় নি, ওনারা বলে দিলেন, লোকেরা ঈশ্বরকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছেন, এবং এই ধার্মিক ‘সেন্টিমেন্ট’ তাঁদের সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা। ‘গভীর ভাবে উপলব্ধি’, ‘সংস্কৃতি’ সেসব তথ্য এল কোত্থেকে?

অবশ্য আশ্চর্য হই নি। ইতালী ইউরোপের অন্যতম ধর্মপ্রাণ দেশ হিসাবে খ্যাত, ভ্যাটিকান’এর আবাস। সেখানের ভদ্রলোক, ডাক্তার হলে কি হবে, বক্তৃতার শেষে ‘দিস ইস মিরাক্‌ল্‌’ বলে চিৎকার করবেন, সে আর বেশি কি। ওই পেপারের লেখক ডাক্তাররাও ইতালীয়, খেয়াল করবেন।

এই তো কদিন আগেই মহামতি পোপ বলেছেন, “বিজ্ঞানীরা তো আর দুনিয়া বানায় নি, তারা সেটার হালচাল শেখার চেষ্টা করে শুধু। তাদের কাজ হচ্ছে তাই এই মহাজাগতিক সূত্রগুলি বোঝার চেষ্টা করা। এবং সেটা বুঝলেই তাই তারা বুঝতে পারে, এক সর্বশক্তিমান ‘কারণ’ এই দুনিয়া চালাচ্ছে – সেটাই হল ভগবান, মানুষ চালাচ্ছে না।” এই দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় লাইনে লাফ দেবার লজিকে যে প্রচণ্ড ফ্যালাসি, সেটা বোঝার ক্ষমতা তাঁর বা অনেকেরই নেই। তাই ওই ভদ্রলোক বা ওই ডাক্তাররা একই ধারণার অনুসরণে যে ‘মেরী’ নামের নেশায় সবাইকে চুর হতে আমন্ত্রণ জানাবেন, এ আর আশ্চর্য কি।

সাধারণ ভাবে ধরা হয়, পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলি বেশি আধুনিক এবং উদারপন্থী, আর পূর্ব ও দক্ষিণের দেশগুলি প্রাচীনপন্থী। বোরখা-ব্যানের মত পদক্ষেপ নিতে থাকা ‘লিবারেল’ ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষিত ক্যাথলিক ডাক্তারের অভাব তাই এখন পড়তেই পারে, আর তার জোগান দিতে ইতালীর চেয়ে উপযুক্ত আর কে? ফ্রান্সে ৭৩% ধর্মকে গুরুত্ব দেয় না, জার্মানীতে ৫৭%, আর ইতালীতে মাত্র ২৬%।

সে তুলনায় আবার আমেরিকাও অনেক বেশি ধর্মনির্ভর। গোঁড়াদের অত্যাচারে ইউরোপ ছেড়ে চলে আসা উদারপন্থী মানুষেরা যখন আমেরিকা প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তাঁদের লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই থেকে আজ ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’য়ে এসে দাঁড় করিয়েছে যীশু-অনুগামীদের দল। কোরান পোড়ানোর তাদের জিগির তাদের পাবলিসিটি স্টান্ট। আমেরিকার স্কুলে ক্রিশ্চান লবিগুলি সফলভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব শেখানো চালু করেছে কয়েক জায়গায়। সেই তুলনায় আজ ইংল্যান্ডের অবস্থা অনেক ভাল। সাম্প্রতিক এক স্টাডিতে আমেরিকার মাত্র ২৬% জনতা বলেছে, মানুষ বহু লক্ষ বছর ধরে ইশ্বরের প্রভাব ছাড়াই বিবর্তিত হয়েছে। সেইটা ইংল্যান্ডে ৪৮% লোক বলেছে। ওই ভদ্রলোক তো আমেরিকাতে আরো উৎসাহ নিয়ে লেকচার দিতে আসবেনই।

(১০)
ইতালি এবং ক্যাথলিকদের কথা যখন তুলেছি, তখন আমাদের ব্যাচের এক ইতালীয় বালিকার গল্প দিয়ে শেষ করি। বালিকা প্রচণ্ড ক্যাথলিক, তার সব কথাতেই ‘ইলাহি ভরসা’। তার একটি বয়ফ্রেন্ড আছে, সে আবার বালিকাকে যত্ন করে কামড়াইতে বড়ই উৎসাহী। কিন্তু ধর্মপ্রাণা বালিকার তাতে খুব আপত্তি। সে বলে, ওগো, আমাকে আগে বিবাহ করে নিজের শ্রীচরণে ঠাঁই দিয়ে নাও, তারপর মনের সুখে কামড়াইবে; কিন্তু বিয়ের আগে একদম ওসব নয়, আমি মাতা মেরীর মতই ভার্জিনাবস্থায় বিবাহ করতে চাই। অনেক ইতালীয় মহিলার মতই এই মেয়েও ‘আদর্শ মাতৃত্বের’ দৃষ্টান্ত স্থাপনে আগ্রহী, বিয়ের অব্যবহিত পরেই সে এক বিশাল পল্টনের উৎপাদন এবং লালনপালন করে সফল এবং প্রবল মাতৃত্বের ধ্বজা ওড়াতে চায়। এ গল্প সে সবাইকেই করে। দুষ্ট পাঠক এ কথা শুনে ভাববেন না, ওই পল্টন উৎপাদনে সে আপনার কোনো অবদান চায়।

মুশকিল হল, ওই ছেলেটি ধর্মটর্মকে পাত্তা দেয় না, সে অজ্ঞেয়বাদী। বান্ধবীর ধর্মচর্চায় কোনো আগ্রহ নেই তার, স্বভাবতই সেই ধর্মের আরোপিত বাধায় কামড়াতে না পেরে সে বড়ই ক্ষুব্ধ। ওদিকে সে পট করে বিয়েও করতে চায় না, তার মত, যখন আমাদের মধ্যে এত বিষয়েই মনের অমিল, তখন এখুনি বিয়ে করে ফেলে পরে ভোগার চেয়ে আরো কিছুদিন দেখে নেওয়া ভাল। সব মিলিয়ে বড়ই জটিল স্টেলমেট।

একই কনফারেন্সে গেলে তারা পাশাপাশি ঘর নেয়, কিন্তু ডবল-বেড একটা রুম নেয় না। আমেরিকাতে এটা বেশ ব্যতিক্রম। এমন কেন জিজ্ঞেস করলে বলে, পাশাপাশি আগুন আর ঘি? যদি ‘টেম্পটেশন’ সামলাতে না পেরে ‘কিছু’ হয়ে যায়? বলি, তাহলে তোমার ধর্মসঞ্জাত চারিত্রিক বলের কি হল? বলে, না, “হিউম্যান নেচার ইজ উইক”।

আবার ছেলেটির ‘হবু স্ত্রী’ হিসাবে খুব অভিমান করে, যখন ছেলেটির সমমনস্ক বন্ধুরা তার বাড়িতে এসে মেয়েটির গোঁড়ামিকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। বলে, হবু হোক, বর তো! তার কি কর্তব্য নয়, স্ত্রীর নিন্দামন্দ দেখলে তেব্র পেতিবাদ করা? বরং সে-ও ওদের সঙ্গে মিলে খিলখিল করে!

এই অচলাবস্থাতেই গল্প শেষ করি। কোনো পাঠক বেশী কৌতূহল দেখিয়ে ফেললে মুশকিল হয়ে যাবে – ছেলেটি আবার খাঁটি সিসিলীয়, কোনোরকম আভাস পেলেই তার পুত্রপৌত্রাদি এসে অনাগত চোদ্দপুরুষকে শুদ্ধু ভেন্ডেটা করে দিয়ে যাবে। সুহৃদ নিধার্মিকদের এহেন বিপদ থেকে সাবধান করা কর্তব্য বইকি। মেয়েটি সবাইকেই বলে, ছেলেটির সুমতি হোক, ভালয় ভালয় আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক, এই দোয়া করুন। শান্তিকামনায় আপনারাও তাই করুন বরং।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন