আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১২

জীবহত্যা ও নৈতিকতা

লিখেছেন মহসিনা খাতুন

গত বছর কোরবানিতে গোহত্যার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ-লেখা দিয়ে বলেছিলাম যে, গোহত্যা অনুচিত। সেদিন থেকে নিয়মিত জিজ্ঞাসা করা হয়েছে নানা প্রশ্ন। কেউ বলেছে, আপনি কি নিরামিষাশী? যদি না হন ,তাহলে এসব নিয়ে বলার অধিকার আছে কি? কেউ বলেছে, আপনি যে ভাত খান, সেসব ও তো প্রাণ হত্যা করেই হয়, তবে কি খাবেন না? খাওয়ার জন্য সবাই তো পশু হত্যা করে, তাহলে ধর্মের বেলায় দোষ হতে যাবে কেন? এরকম অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে আমাকে। কেউ বুঝেছে, বেশিরভাগ লোকেই বুঝতে চায়নি। তাই আমার এই লেখা। 

কোনো কাজের উচিত-অনুচিত বিচার করা হয় যে শাস্ত্রে, সেটাকে নীতিবিজ্ঞান বলা হয়। এই নীতিবিদ্যার উন্নতি এতটা হয়েছে যে, তাকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এবং বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সকল বিষয়ে আমাদের ক্রিয়াকলাপের ফলে যেসব বাস্তব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলোর সমাধানের জন্য আমাদের কাজের উচিত-অনুচিত বিচার করে নীতিবিদ্যার একটি শাখা। নাম অ্যাপ্লায়েড এথিকস বা ব্যবহারিক নীতিবিদ্যা। 

সাবেকী বা ক্লাসিক্যাল নীতিবিদ্যায় অনেক বিতর্কের পর সবশেষে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, সেই কাজকেই ভাল বলা হবে, যে কাজ উপযোগী। উপযোগিতার সংজ্ঞায় তারা বলে, যে কাজ দুঃখের তুলনায় সার্বিকভাবে সুখ বেশি উৎপন্ন করতে পারে, সেই কাজ তত উপযোগী। যে কাজ মানুষের পক্ষে সার্বিকভাবে যত বেশি উপযোগী, সেই কাজ তত ভাল অর্থাৎ তত বেশি তা করা উচিত। তাই ব্যবহারিক নীতিবিদ্যাও এই তত্ত্বকেই স্বীকার্য হিসাবে ধরে নিয়ে সমস্যার বিশ্লেষণ করে। এখন দেখা যাক, অ্যাপ্লায়েড এথিকস পশুহত্যাকে কীভাবে দেখে। 

আচ্ছা, যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, সুস্থ-সবল-স্বাভাবিক একজন মানুষকে হত্যা কি ভাল না খারাপ? উত্তর আসবে, খারাপ। সেটাই স্বাভাবিক। কোনো সুস্থ মানুষ এইরকম হত্যাকে সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু কেন? জীব বলে? তাহলে তো ধান কাটাও খারাপ। তবে কি শুধু প্রাণী বলে? তাহলে নিশ্চয়ই মশা হত্যাকেও একই মানদণ্ডে তোলা হত। কিন্তু তা তো হয় না। ধানগাছ বা মশা হত্যা কে আমরা খারাপ বলে মনে করি না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যখন বলি নরহত্যা (মানুষ হত্যা) খারাপ, তখন আমরা ‘মানুষ’ শব্দের দ্বারা আমরা কিন্তু ‘একটি জীব বিশেষ’ বা ‘একটি প্রাণী বিশেষ’ বোঝাতে চাই না। তাহলে তখন আমরা ‘মানুষ’ শব্দটির কী অর্থ করছি? অর্থাৎ ‘মানুষ’ শব্দটিকে আমরা কোন অর্থে গ্রহণ করছি? এই প্রশ্নটির সমাধানে নীতিবিদ ও দার্শনিকরা বহুদিন ধরে আলোচনা করে এসেছেন। আধুনিক নীতিবিদদের মধ্যেও এই বিতর্ক দেখা গেছে। ৬০-এর দশকের বিখ্যাত জীব নীতিবিদ এবং খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ববিদ জোসেফ ফ্লেচার মনে করেন যে, এই ক্ষেত্রে ‘মানুষ’ শব্দটিকে আমরা ‘মনুষ্যত্ব জাতির অন্তর্ভুক্ত জীব’ বলে মনে করি। তিনি মনুষ্যত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন। সেগুলি হল, আত্মসচেতনতা, আত্ম-সংযম, অতীত-বোধ, ভবিষ্যৎ-দর্শিতা, পরচিন্তা, অন্য বিষয়ের সাথে আদানপ্রদান ও সম্বন্ধ স্থাপনের সামর্থ্য ও কৌতূহল। এই বৈশিষ্ট্যগুলি যার মধ্যে থাকে, সে-ই মানুষ। কিন্তু সমস্যা হল, এই বক্তব্য যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে সদ্যজাত শিশু, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন শিশু, এদের মানুষ বলা যাবে না। এবং তাদের হত্যা করাও অপরাধ রূপে গণ্য করা যাবে না। তাই ফ্লেচারের বক্তব্য বাতিল করা হয়েছে। সমসাময়িক নীতিবিদ পিটার সিঙ্গার এই বিষয়ে যে মত প্রকাশ করে বলেন, তখন আমরা মানুষ শব্দটিকে জীব, প্রাণী বা মানুষ জাতির সভ্য হিসাবে গ্রহণ না করে ‘ব্যক্তি’ (person) অর্থে গ্রহণ করি। 

এখন জেনে নিতে হবে ব্যক্তি বলতে কী বোঝায়? দার্শনিক তথা নীতিবিদদের মতে, যার মধ্যে আত্মসচেতনতা এবং বিচারসামর্থ্য আছে, এমন জীবই ব্যক্তি। পিটার সিঙ্গারও এই সংজ্ঞাকেই মেনে নিয়েছেন। ব্যক্তিকে হত্যা করা কেন অনুচিত? কারণ উপযোগবাদ অনুসারে, কোনো একটি ক্রিয়াকে তখনই ভাল বলবো, যখন তা দুঃখের চেয়ে বেশি সুখ উৎপন্ন করবে। আমরা জানি, প্রতিটি ব্যক্তি মনে করে যে, তার বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এবং মৃত্যুকে সে অবাঞ্ছিত মনে করে। নরহত্যাকে আইনসিদ্ধ করে দিলে প্রথম সমস্যা হবে যে, ঐ ব্যক্তির বেঁচে থেকে সুখলাভের সমস্ত অধিকার তো কেরে নেওয়া হল এবং হত্যার সময় কষ্ট হল। তাছাড়া হত্যা আইনসিদ্ধ হলে প্রতিটি মানুষকে সারাজীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হবে মৃত্যুভয় নিয়ে। যা সুখের চেয়ে নিশ্চিতভাবে দুঃখ বেশি উৎপন্ন করবে। এই জন্য প্রাচীনকালে গ্রীস রোম ও ভারতবর্ষে গড়ে ওঠা সভ্যতাগুলোতেও চিন্তাশীল জীবকে হত্যা করাকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু চিন্তাশীলতা বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা না জানার কারণে বহু স্থানে কোথাও কোথাও শিশুহত্যাকেও অপরাধ রূপে গণ্য করা হয়নি। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে, বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের সময়ে এই নৃশংস প্রথা চালু থাকলেও তাঁরা কিন্তু কখনই এর বিরোধিতা করেননি। 

এখন প্রশ্ন যে, কেবল মানুষই কি ব্যক্তি পদের উপযুক্ত? অ-মানুষ কোনও প্রাণী কি ব্যক্তি হতে পারে না? প্রশ্নটি হাস্যকর লাগতে পারে। মানুষ নয় এমন কোনও প্রাণীকে ব্যক্তি বলা অস্বাভাবিক শোনায়। কিন্তু বাস্তবে আমরা ব্যক্তির যে-সংজ্ঞা দিয়েছি, তার ভিত্তিতে প্রশ্নটির পুনর্বিন্যাস করলে আর অস্বাভাবিকতা থাকে না। আসলে আমরা যে-প্রশ্ন করলাম, সেটি দু'টি প্রশ্ন: 

১) অ-মানব প্রাণীর কি আত্মসচেতনতা থাকতে পারে? 

২) অ-মানব ব্যক্তির কি চিন্তাসামর্থ্য বা বিচারসামর্থ্য থাকে? 

এখান থেকেই বোঝা যায় যে, প্রশ্নটি মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা আলাদা আলাদাভাবে এই প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করব। 

প্রথম প্রশ্ন , অ-মানব প্রাণীর কি আত্ম সচেতনতা থাকতে পারে? এতদিন ভাবা হত যে, মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর আত্মসচেতনতা থাকে না। কিন্তু বর্তমানে দেখা গেছে সব প্রাণীর না হোক, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, অন্তত কিছু প্রাণীর আত্মসচেতনতা আছে। পিটার সিঙ্গার তার Practical Ethics বইতে দেখিয়েছেন, “ওয়াসু নামের একটি শিম্পাঞ্জীকে মানুষের ভাষা শিক্ষা দেওয়া গেছে। সে ৩৫০ টি ভাষা-প্রতীক ব্যবহার করতে পারতো। এটি একটি বিস্ময়কর সাফল্য যে, ওয়াসু ১৫০ টির বেশি প্রতীকের সঠিকতম ব্যবহার করতে পারতো। ওয়াসু আত্মসচেতন ছিল। তাকে যখন আয়না দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করা হত যে,  “এটি কে?” সে উত্তর দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে উত্তর দিত, “আমি ওয়াসু।” সুতরাং তার আত্মসচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। নিজের ভবিষ্যৎ-ইচ্ছা ব্যক্ত করতেও সে ওই প্রতীক ব্যবহার করতে পারতো। এই পরীক্ষাটি করেছিলেন আমেরিকার দুইজন বৈজ্ঞানিক অ্যালেন এবং বেয়াট্রিচ গার্ডনার। এই পরীক্ষাটি থেকে সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল যে, শিম্পাঞ্জীর অভাব বুদ্ধির নয়, পরিণত বাগযন্ত্রের। একজন বোবা মানুষের সাথে তার কোনও মূল পার্থক্য নেই। এরপর একে একে অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রে এই সাফল্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, গরিলা, বানর, তিমি, ডলফিন, এমনকি গরুও আত্মসচেতন। 

এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন, অমানুষ প্রাণীদের কি চিন্তা- বা বিচারসামর্থ্য আছে? উত্তরে বলা যায়, যার আত্মসচেতনতা আছে, তার বিচারসামর্থ্যও থাকতে বাধ্য। কেননা  নিজেকে চিনতে গেলে অন্যের থেকে নিজেকে আলাদা করার সামর্থ্য থাকতে হয়। আর এটাই প্রমাণ করে যে, তাঁর চিন্তা বা বিচারসামর্থ্য আছে। আরও একটি পরীক্ষার উদাহরণ দিয়েছেন পিটার সিঙ্গার: 

“একটি শিম্পাঞ্জীকে সারিবদ্ধ কিছু বস্তুর মধ্য থেকে মধ্যবর্তী বস্তুটিকে নির্বাচন করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল ।এমনকি যখন বস্তুগুলিকে সারিবদ্ধ ভাবে ঠিক ব্যবধানে রাখা হয় নি, তখনো শিম্পাঞ্জীটি সারিবদ্ধ বস্তুগুলির মধ্যে মধ্যবর্তীটিকে ওঠাতে পেরেছিল। অর্থাৎ তার মধ্যে সামর্থ্য আছে ‘মধ্যবর্তী বস্তুর ধারণা’-র উপলব্ধি করার। তিন-চার বছরের ভাষা ব্যবহারকারী অনেক দক্ষ মানবশিশু এই কাজটি করতে পারে না।” 

বানর এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীও এর থেকে অনেক কঠিন বুদ্ধি-পরীক্ষায় সফল হয়েছে। এমনকি জেনে অবাক হবেন, এদের মধ্যে গোপন পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করা , এমনকি রহস্যোদ্ধার করার সামর্থ্যও বর্তমান। শুধু তা-ই নয়, এইসব প্রাণীদের হত্যা করলে দেখা যায়, তা অন্যের দুঃখেরও কারণ হয়। যেমন, “একটি শাবকের মৃত্যু হলে দেখা যায় গাভী মাতা অনেকদিন পর্যন্ত শূন্য দৃষ্টিতে তাঁর সন্তানকে কামনা করে। মাঝে মাঝে করুণ রবে কেঁদে ওঠে।” এমনকি এও দেখা যায় যে, অনেকদিন একসাথে থাকা গরুর একটিকে হত্যা করলে বাকিদের ব্যবহারে পরিবর্তন আসে। তারাও শোকগ্রস্ত হয়। এ থেকে বোঝা যায় যে, তাদেরও মৃত্যু সম্পর্কে ধারণা থাকে। 

সুতরাং খুব স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, এই ধরনের প্রাণীর আত্মসচেতনতা ও বিচারসামর্থ্য আছে। তাই এরা ব্যক্তি পদবাচ্য। আমরা এদের ভাষা বুঝতে পারি না ঠিক, কিন্তু তাই বলে আমরা ভাবতে পারি না যে, এদের ভাষা নেই। কিন্তু আমরা যে শুধু এটাই ভাবি, তা নয়। বরং এর থেকে আরও একধাপ এগিয়ে সিদ্ধান্ত করে বসি যে, এদের চিন্তা- বা বিচারসামর্থ্য নেই। কিন্তু বাস্তবে ব্যক্তি হিসাবে এরা কোনো মানুষের থেকে কম নয়। আর ব্যক্তি পদবাচ্য হওয়ায় এদের হত্যা করলে সুখের তুলনায় দুঃখ বেশি উৎপন্ন হয় এভাবে: 

১) এদের হত্যার আগে ও হত্যার সময় উৎপন্ন দুঃখ। 

২) এদের হত্যা করার পর এদের সঙ্গী বা সঙ্গীদের কষ্ট রূপে উৎপন্ন দুঃখ। 

৩) এদের সুখবৃদ্ধি করার অধিকার কেড়ে নেওয়া । 

অন্যদিকে উৎপন্ন দুঃখের তুলনায় সুখের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য। 

১) তাদের খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি বা বিক্রি করে অর্থ রোজগার। 

এই সুখ উৎপন্ন দুঃখের তুলনায় নিতান্তই কম। তাই উপযোগবাদী নীতি-তত্ত্ব ও অ্যাপ্লায়েড এথিকস এই ক্ষুদ্র লাভজনিত সুখের জন্য এদের হত্যা কে অনুচিত বলে মনে করে। 

আরও একটা প্রশ্নের আলোচনা করা হয়নি, আরেক ধরনের জীবের কথা, যারা সংবেদনশীল হলেও আত্ম-সচেতন না হওয়ার কারণে তাদের ব্যক্তি বলা যায় না। যেমন মাছ, মুরগি ইত্যাদি। মানুষ প্রতিদিন অসংখ্য মাছ মুরগি হত্যা করে খাদ্যের জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত কষ্ট দিয়ে দীর্ঘক্ষণ বাঁচিয়ে রেখে প্রাণী হত্যা করা হয়। ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে মুরগি কে, দেহে অগ্নিশলাকা প্রবিষ্ট করে শুকরকে, ছাগল, গরু, ভেড়াকে এক কোপে না কেটে আস্তে আস্তে অনেক সময় ধরে কেটে হত্যা করা হয়। শুধু খাওয়ার জন্য নয়, বরং কিছু কাল্পনিক শক্তি বা ব্যক্তিকে খুশি করার জন্যও অযথা অসংখ্য প্রাণীকে হত্যা করা হয়। এই জীবগুলির আত্মসচেতনতার প্রশ্ন না তুলেও (অর্থাৎ যদি ধরে নিই যে, তারা আত্মসচেতন নয়) প্রশ্ন করা যায় যে, তারা তো সংবেদনশীল জীব! তাদের হত্যা করা কি উচিত ? 

নীতিবিদ্যায় এই প্রশ্নটি এখনো বিতর্কিত। উপযোগ-নীতিতত্ত্ববাদীরা এই বিষয়ে দ্বিধা বিভক্ত। প্রথমদল যে মতবাদ মানেন, তা হল ‘অস্তিত্বকেন্দ্রিক মতবাদ।’ এই মতানুসারে, একটি প্রাণী ব্যক্তি না হতে পারে, কিন্তু যতদিন সে বেঁচে থেকে, ততদিন দুঃখের তুলনায় সুখের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়। তাকে হত্যা করার অর্থ তাকে যন্ত্রণা দেওয়া তো হলই, সাথে সাথে তার সুখের অনুভূতিও চিরকালের জন্য কেড়ে নেওয়া হয়। তাই যে প্রাণী সুখের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সমর্থ, ক্ষণিকের খাদ্য-সুখের জন্য তার হত্যা সব সময়ের জন্যই অন্যায়। অপর-দল এই ধরনের প্রাণীহত্যাকে সমর্থন করেন। এদের মতবাদকে ‘সামগ্রিক সুখ মতবাদ’ বলে। এই মতবাদে একটি যুক্তি দেয়া হয়, যার নাম ‘প্রতিস্থাপনের যুক্তি।’ এই যুক্তি অনুসারে, কেবল সংবেদনশীল জীব সুখের আধার রূপেই মূল্যবান। কাজেই একটি আধার বিনষ্ট করে যদি অনেকগুলি সুখের আধার উৎপন্ন করা যায় (অর্থাৎ একটি মাছকে হত্যা করে যদি অনেকগুলো মাছ উৎপন্ন করা যায়), তাহলে টা অন্যায় হবে না। কেননা, এসব ক্ষেত্রে একটি ক্ষুদ্র জীবের সামান্য পরিমাণ সুখ বিনষ্ট হলেও জগতের সামগ্রিক সুখের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পাবে। 

তবে প্রতিস্থাপনের যুক্তিও সমালোচিত হয়েছে। কেননা, একটি জীবকে হত্যা করে, একাধিক জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে যে খামার, পুকুর ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়, সেখানে প্রাণীরা সুখী জীবন যাপন করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, বিনষ্ট করা সুখ আমাদের কাছে সামান্য হলেও সেই জীবটির কাছে সারা জীবনের। তাছাড়া একটি জীবকে হত্যা করলেও তার সুখকে অন্য জীবে প্রতিস্থাপন করা যায় না। তাই সামগ্রিক সুখ মতবাদেও এই ধরনের কেবল সংবেদনশীল জীব হত্যা সমর্থনকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। 

তাই পিটার সিঙ্গার তার Practical Ethics নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থে বলেছেন, “কেবল কয়েকটি ক্ষেত্রে কেবল সংবেদনশীল জীব কে যন্ত্রণা-বিদ্ধ (বেশি সময় ধরে যন্ত্রণা দিয়ে) না করে হত্যা করা হয়, তাদের মৃত্যু জীবিতের দুঃখবৃদ্ধির কারণ না হয় এবং তাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনুরূপ অন্যান্য অনেক জীব উৎপন্ন করা সম্ভব হতে পারে ,এমন ক্ষেত্রে আত্মসচেতনতা-হীন জীব হত্যা অনুচিত বা মন্দ না-ও হতে পারে।” 

কিন্তু এত আলোচনা ও যুক্তি তর্ক সত্ত্বেও একদল নীতিবিজ্ঞানী, বিশেষত যারা আব্রাহামিক ধর্মদর্শনে বিশ্বাস করেন, তারা চিরকাল সক্রিয় এটা প্রমাণ করতে যে, সমস্ত জগতই মানুষের স্বার্থের জন্য প্রদত্ত। তাই মানুষের প্রয়োজনে পশুদের হত্যা অন্যায় নয়। তা সে যতই বিচারশীল জীব হোক না কেন? মানুষের দায়বদ্ধতা কেবল মানুষের কাছে। তবে তারা যা- বলে থাক না কেন, আসল কথা হল, আমরা নিজেদের পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জীব মনে করি। তাই মানুষের দায়বদ্ধতা সবার উপরে, সকল জীব এবং জড়ের উপরেও। এই দায়িত্ব কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন