লিখেছেন অ্যাডমিন, যুক্তি
ধর্মের সমালোচনা করতে গেলে বা এর ভ্রান্তি চিহ্নিত করতে গেলে সর্বপ্রথমেই যে ধরনের বিরোধিতা ওঠে আসে তা হলো- "জনসাধারণের উপাসনা-ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না।" বড়ই বিচিত্র এই ধর্মীয় অনুভূতি! কারণ অন্য ধর্মাবলম্বীদের যে ধর্মহীন মনে করে থাকে প্রত্যেক ধর্ম, সেটা তো সবাই জানেন, কিন্তু স্ব-স্ব ধর্মের মধ্যেই যে বিভিন্ন বাদ-মতবাদে বিভক্তি রয়েছে (যেমন- ইসলামের মধ্যে শিয়া, সুন্নী, ওহাবি ইত্যাদি, খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক, প্রোটস্ট্যান্ট, হিন্দুদের বৈষ্ণব, শাক্ত, ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র ইত্যাদি), তারাই তো একে অন্যকে ধর্মহীন বলে মনে করেন, এবং নিজেদেরকে একমাত্র সঠিক ধর্মের ধারক এবং উঁচু জাতের বলে দাবি করেন। তখন একে অপরের বক্তব্যে কি তাঁদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে না? শুদ্রদের নিয়ে ব্রাক্ষ্মণদের যে ঘৃণ্য অস্পৃশ্যসুলভ মনোভাব, সেটা কি ধর্ম (মনুর বিধান) থেকে আসেনি? ক্যাথলিকদের সাথে প্রোটস্ট্যান্টদের লড়াই ঐতিহাসিক কাল থেকেই চলে আসছে, শিয়া-সুন্নী মতবাদ নিয়ে ইসলামের মধ্যে যে রক্তারক্তি কাণ্ড চৌদ্দশো বছর আগে শুরু হয়েছে, তা তো এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজ-নিজ ধর্ম প্রসারের সাথে সাথে তালুক দখলের লোভ। এখানে পবিত্র অনুভূতি-টনুভূতি সব মিথ্যে, মানুষে মানুষে শুধু জিঘাংসাই বৃদ্ধি করেছে। ফলে সত্য সন্ধানের জন্য ভাববাদীদের আদুরে দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলেই তাঁদের রেশম কোমল ধর্মীয় অনুভূতিতে কাঁটা বেঁধার ব্যথা অনুভূত হয়! (যুক্তির খাতিরে মেনে নেয়া যাক, অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা অন্যায়। কিন্তু তাবৎ ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে বা এর নানা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির মাধ্যমে পৃথিবীর সকল ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের নাস্তিকীয় অনুভূতিতে প্রতি মুহূর্তে আঘাত করে চলছে, এটা কি অন্যায় নয়? নাকি ঈশ্বর-অবিশ্বাসীদের কোনো অনুভূতি নেই বা থাকা উচিত নয়!
যা হোক, এই ধরনের কথিত উপাসনা-ধর্মীয় অনুভূতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বেশ সুন্দর করে সুনির্দিষ্ট কিছু মন্তব্য করেছেন, যা প্রণিধানযোগ্য:
মানুষ বিশ্বকে অনুভব করে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে; ইন্দ্রিয়গুলো মানুষকে দেয় রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শ্রুতির অনুভূতি; কিন্তু মানুষ, একমাত্র প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল প্রাণী মহাবিশ্বে, শুধু এ-পাঁচটি ইন্দ্রিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, তার আছে অজস্র ইন্দ্রিয়াতীত ইন্দ্রিয়। তার আছে একটি ইন্দ্রিয়, যার নাম দিতে পারি সৌন্দর্যেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে সৌন্দর্য; আছে একটি ইন্দ্রিয়, নাম দিতে পারি শিল্পেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে উপভোগ করে শিল্পকলা; এমন অনেক ইন্দ্রিয় রয়েছে তার, সেগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রখর প্রবল প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে তার ধর্মেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে ধর্ম, তার ভেতরে বিকশিত হয় ধর্মানুভূতি, এবং আজকের অধার্মিক বিশ্বে তার স্পর্শকাতর ধর্মানুভূতি আহত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয় ভোরবেলা থেকে ভোরবেলা। অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরাভূত ক’রে এখন এটিই হয়ে উঠেছে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়; ধর্মেন্দ্রিয় সারাক্ষণ জেগে থাকে, তার চোখে ঘুম নেই; জেগে জেগে সে পাহারা দেয় ধর্মানুভূতিকে, মাঝেমাঝেই আহত হয়ে চিৎকার ক’রে ওঠে, বোধ করে প্রচণ্ড উত্তেজনা। এটা শিল্পানুভূতির মতো দুর্বল অনুভূতি নয় যে আহত হওয়ার যন্ত্রণা একলাই সহ্য করবে। এটা আহত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মানুভূতির উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন বিশ্ব কাঁপছে।
এরপর তিনি আরো একটু ব্যাখ্যা করে বলেছেন-
...পৃথিবীতে সম্ভবত এখন বিশুদ্ধ ধার্মিক নেই, থাকলে তাদের ধর্মানুভূতি খুবই আহত হতো। যেমন, মন্দির দেখে আহত হ’তে পারে একজন ধার্মিক মুসলমানের ধর্মানুভূতি, কেননা তার বিশ্বাসের জগতে মন্দির থাকতে পারে না; আবার মসজিদ দেখে আহত হ’তে পারে একজন ধার্মিক হিন্দুর ধর্মানুভূতি, কেননা তার বিশ্বাসে মসজিদ অবাঞ্ছিত। একজন মমিন মুসলমান যদি দাবি করে যে, মন্দির দেখে তার ধর্মানুভূতি আহত হয়েছে, তাই মন্দিরটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে, তখন রাষ্ট্র কী করবে; একজন বিশুদ্ধ হিন্দু যদি দাবি করে যে মসজিদ দেখে তার ধর্মানুভূতি আহত হয়েছে, তখন কী করবে রাষ্ট্র? খাঁটি/মমিন/বিশুদ্ধ ধার্মিকের কোমল ধর্মানুভূতি আহত হ’তে পারে প্রতি মুহূর্তেই; টেলিভিশন, সিনেমা, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের, সংসদে নারীদের দেখে আহত হ’তে পারে তার ধর্মানুভূতি, এবং সে এসব নিষিদ্ধ করার জন্যে আবেদন জানাতে পারে। পৃথিবী এবং গ্রহগুলো ঘোরে সূর্যকে কেন্দ্র ক’রে, মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছে ‘বিগ ব্যাং‘ বা মহাগর্জনের ফলে, সেটি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, হয়েছে আজ থেকে একহাজার থেকে দু-হাজার কোটি বছর আগে, তারপর থেকে সম্প্রসারিত হয়ে চলছে, সূর্য আর গ্রহগুলো উদ্ভুত হয়েছে সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে, মানুষ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আসে নি, বিবর্তনের ফলে বিকশিত হয়েছে বিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ বছর আগে, পাহাড়গুলো পেরেক নয় ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক সত্য বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়;- এগুলোতে প্রচ¨ভাবে আহত হ’তে পারে ধার্মিকদের ধর্মানুভূতি, তারা এগুলো নিষিদ্ধ করার জন্যে দাবি জানাতে পারে। তখন রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্র কি নিষিদ্ধ করবে বিজ্ঞান? তারপর ধর্মানুভূতি যেহেতু সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক, তাই তা কতোটা আহত হলো, তা পরিমাপ করা উপায় নেই। যুক্তি দিয়ে অযুক্তিকে মাপা যায় না।পুনশ্চ. প্রাসঙ্গিক একটি ছড়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন