লিখেছেন সেক্যুলার ফ্রাইডে
রূপকথা (Fiction) হলো সংক্ষিপ্ত কাল্পনিক গদ্য বা পদ্য, যা আনন্দদায়ক ও মজার, কিন্তু জাদু, অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বা এ ধরনের অন্যান্য জিনিসকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে বলে অত্যন্ত অভাবনীয় বিবরণে পরিপূর্ণ। রূপকথাগুলোতে প্রায়শই বিভিন্ন কাল্পনিক প্রাণী এবং তাদের অবিশ্বাস্য, অবাস্তব ও বিভ্রান্তিকর ঐন্দ্রজালিক সমাধানের বর্ণনা পাওয়া যায়। রূপকথার অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - এই গল্পগুলো মানুষের মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়ায়।
কল্পনা শব্দটা সবসময় নেতিবাচক নয়।
যুক্তিগ্রাহ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কল্পনা-প্রতিভা (Imagination) আত্মোন্নয়নের জন্য, অসম্ভবকে দৃশ্যমান করার জন্য, নতুন কিছু করার জন্য, প্রগতি অভিমুখী হওয়ার জন্য, চিন্তা ও মননকে বিকশিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যৌক্তিক চিন্তার বিপরীতে জাদু, ইন্দ্রজাল, মায়াবিদ্যা, গুপ্ত শক্তি, ভোজবাজি, অলৌকিক বা ঐন্দ্রজালিক সমাধান যখন মানুষের জীবনে প্রাধান্য পায়, তখন সেটা প্রগতির বিরুদ্ধাচারণ করে, তখন সেটা হয়ে ওঠে যুক্তিকে অগ্রাহ্য করা দিবাস্বপ্ন বা ভাবাবেশ বা আজগুবি কল্পনা (fantasy), যা চিন্তা ও মননকে বিকশিত করার পরিবর্তে ঠেলে দেয় অন্ধবিশ্বাসের পথে।
কল্পনা-প্রতিভা (Imagination) নিয়ে বাঁচাটা ইতিবাচক; আজগুবি কল্পনা (fantasy) নিয়ে বাঁচাটা নেতিবাচক।
আধ্যাত্মিক চেতনা, অলৌকিক সত্তায় বিশ্বাস, কথিত আচার ও নির্দেশের চর্চা, অনুধাবন এবং পালন প্রতিটি ধর্মেই অত্যাবশ্যকীয়। ধর্ম ঐন্দ্রজালিক সমাধানে বিশ্বাস করে বলেই ধর্ম হচ্ছে আজগুবি কল্পনার জগৎ; আর সেজন্যই ধর্মে বিশ্বাসও নেতিবাচক।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মকে সত্য বলে মানে ও পালন করে। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সকলকেই "গায়েব" বা অদৃশ্য শক্তিতে, তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধিতে, তাঁর প্রেরিত বাণীতে এবং তাঁর ঘোষিত পরকালের শাস্তি ও পুরস্কারে বিশ্বাসী হতে হয়।
তাদের বিশ্বাস করতে হয় নূরের তৈরি ফেরেশতা ও আগুনের তৈরি জ্বিন নামক অদৃশ্য প্রাণীতে, যারা মানুষের ওপর অলৌকিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম, এবং এই বিশ্বাস বাধ্যতামূলক। তারা বিশ্বাস করে পৃথিবী সৃষ্টির পর মহাকাশের সৃষ্টি হয়েছে; শুকনো খটখটে মাটি থেকে ৯০ ফুট লম্বা আদম নামের পুরুষের জন্ম হয়েছে, পুরুষ আদমের হাড় থেকে নারীর জন্ম হয়েছে; সকল যুক্তির বিপরীতে এই আদম ও তাঁর সঙ্গিনীর শত শত বৎসর বেঁচে থাকার ইতিহাসেও তাদের পূর্ণ আস্থা আনতে হয়; তাদের এও মানতে হয় - পিতা ছাড়াই ঈশা নামের এক মানুষ অলৌকিকভাবে জন্মেছিল।
তাদের আস্থা রাখতে হয় কোনো এক কথিত মহাপ্লাবনে, যাতে সম্পূর্ণ সৃষ্টি বিলুপ্ত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে একটি নৌকায় জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করা প্রাণীগুলো থেকে এই বিশাল প্রাণীজগৎ পুনরায় তৈরি হয়েছে। রূপকথার এই গল্পগুলির প্রতি অদ্ভুত এক মুগ্ধতায় তারা ধর্মবর্ণিত অজাচারকেও (Incest) ন্যায্যতা দেয়, তাও একবার নয়, দু'বার!
তারা বিশ্বাস করে যে, কোনো এক কালে কোনো এক মাছ একটি গোটা মানুষকে গিলে খেয়েছিল, কিন্তু তারপরও সেই মানুষটি মাছের পেটে দীর্ঘদিন বেঁচে ছিল, সেই মাছের পেটেই জন্মানো গাছের পাতা খেয়ে; এক পর্যায়ে সে আবার জীবিত বের হয়ে আসে। তারা বিশ্বাস করে যে, একদিন হঠাৎ করে কিছু মানুষ বানর হয়ে গিয়েছিল, কিছু মানুষ হারিয়ে গিয়ে ইঁদুর হয়ে গেছে। পশুপাখির সাথে মানুষের বাক্যালাপেও তাদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে, বিশ্বাস আছে ইয়াজুস-মাজুস, দাজ্জাল নামের অপ্রাকৃত প্রাণীর অস্তিত্বে।
মহাকর্ষ বলে কোনো প্রভাব বিস্তার করা ছাড়াই চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ও জোড়া লাগার ব্যাপারেও তারা নিঃসন্দেহ। তারা নিঃসন্দেহ মেরাজ নামের অভাবনীয় এক নভোযাত্রাতে, যাতে মুহাম্মদ নামের মানুষটি বায়ুশূন্য মহাকাশে নারীমুখী এক পাখাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে এসেছেন। তিনি আল্লাহকে দেখে এসেছেন সেটাও তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনাতেও তাদের পূর্ণ আস্থা আছে। সেখানে বর্ণিত হুর-পরীর সান্নিধ্যের লিপ্সা, আকাঙ্ক্ষা আর আকুলতা তাদের এতই প্রবল যে, সে বর্ণনায় ন্যূনতম সন্দেহ প্রকাশ করলেই তারা ভয়ানক নিষ্ঠুররকম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
আদ্যন্ত রূপকথায় বিশ্বাসী এই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন থেকে তাদের ঠাকুরদার ঝুলিটিকে কোরআন বলে অভিহিত করে, সেটাকেই একমাত্র সত্যগ্রন্থ বলে আসছে। উপরন্তু সেটাকে সকল জ্ঞানের, সকল নৈতিকতার, সকল আইনের উৎস বলে দাবি করে অন্য সকলকে সেটা মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করে চলেছে। ক্ষেত্র বিশেষে তারা সহিংসও হয়ে উঠছে।
চরম নির্বুদ্ধিতায় এরা এমনকি প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোকেও অস্বীকার করতে দ্বিধা করে না। কথিত সত্য গ্রন্থের পবিত্রতা রক্ষায় দলে দলে প্রাণদান করা ও প্রাণ হরণ করাও তাদের কাছে মর্যাদার। সে হুমকিও প্রকাশ্যেই তারা দেয়।
একবিংশ শতকে এসে রূপকথায় বিশ্বাস করা বর্বর এই গোষ্ঠীর সাথে সহাবস্থান পৃথিবীবাসীর জন্য যে কতটা কষ্টের, সে বোধটাই এদের নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন