লিখেছেন জুলিয়াস সিজার
জন্মটা হিন্দুর ঘরে হওয়ার কারণে বাঙালি মুসলমানের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে রবীন্দ্রনাথ একটা জ্যান্ত যমদূতের নাম। বাংলা সাহিত্য মানেই রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ মানেই বাংলা সাহিত্য, এই সত্যটা তারা জানে। তারা জানে, যতই রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক তকমা দেওয়া হোক কিংবা বলা হোক বৃটিশদের দালাল, এতে রবীন্দ্রনাথের কিছুই হয় না। বাংলা থাকলে, বাঙালি থাকলে, বাংলা সাহিত্য থাকলে রবীন্দ্রনাথও থাকবেন, এই ধ্রুব সত্যটা জেনেই এই মূর্খরা রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতায় নামে এবং এটা তারা ঈমানি দায়িত্ব হিসেবেই নেয়। বাঙালি মুসলমানের একটা বিরাট অংশ রবীন্দ্রনাথকে কবি বলেই স্বীকার করতে চান না।
অথচ বিশ্বে বাঙালিদের গৌরব কিংবা বাঙালি বলতে ইউরোপিয়ান-আমেরিকানরা যে-মানুষটিকে চেনেন, সেটা আমাদের রবীন্দ্রনাথ। দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের যে বাড়িটিতে মহান নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র জন্মেছিলেন, সেই বাড়িটির বাগানে একজন মাত্র বিখ্যাত ব্যক্তির আবক্ষমূর্তি বসানো আছে। জানেন সেটা কার?
- আমাদের রবীন্দ্রনাথের। বাঙালির রবীন্দ্রনাথ।
লেখক গোলাম মুরশিদ সেই বাড়িটি ভ্রমণে গেলে উনার সহযাত্রী যে-বাঙালি মুসলমানটি ছিলেন, তিনি বলছিলেন: "সামনের বার এখানে আসলে রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে এখানে একটি নজরুলের মূর্তি বসিয়ে যাব।"
অথচ ঐ লোক ৩০ বছর ধরে বিলেতের বাসিন্দা। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আর বাঙালি মুসলমান ইংল্যান্ডে গিয়েও ধর্মান্ধ থাকে!
এই শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানেরা রবীন্দ্রনাথ-বিরোধিতা করে কায়দা করে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ গোঁড়া হিন্দু ছিলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন, তিনি বৃটিশদের দালালি করতেন ইত্যাদি। এসব খোঁড়া অজুহাত।
রবীন্দ্রনাথ গোঁড়া হিন্দু?
তাঁর বেশভূষা ছিল মোল্লাদের মতো। বিরাট আলখেল্লা, মুখে দাড়ি। তাঁর বাড়ির পাচক ছিলেন মুসলিম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গেদু মিয়া। একবার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হওয়ার উপক্রম হলে রবীন্দ্রনাথ গেদু মিয়াকে বলেছিলেন, ""শোন গেদু মিয়া, পরিস্থিতি ভালো না। ধর্মান্ধরা যেকোন সময় একটা রক্তারক্তি ঘটিয়ে ফেলতে পারে। কেউ যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার ধর্ম কী, তুমি সরাসরি উত্তর দেবে রবীন্দ্রনাথের ধর্মই আমার ধর্ম। আমি বাঙালি।"
রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিলে এদেশের মুসলমানদের একটা অংশের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। তারা মুসলমানদের দেশে হিন্দু (!) কবি রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে আল্লাহর গজব পড়বে বলে লিফলেট বিলি করে উস্কানি দেয়।
এই গুজব ছড়ানোর দল মাদ্রাসা পড়ুয়া কিংবা কাঠমোল্লা। তারা এক পর্যায়ের রবীন্দ্রনাথ-বিরোধী।
এর বাইরে আছেন বাংলার রাজনীতিবিদেরাও। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে এ দেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টায় ছিলেন। রাজাকারকে রাষ্ট্রপতি বানানো, রাজাকারদের পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসি দেওো - এসব কাজ তিনি বেশ সুচারুভাবে করেছিলেন। তিনি বলতেন, সময় আসুক, হিন্দু কবির লেখা জাতীয় সঙ্গীতটাও পাল্টানো হবে।
এই তো গত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা রাজকার সাকা চৌধুরী বলেছিল, "দেশ স্বাধীন করলাম আমরা, আর জাতীয় সংগীত লিখল কোথাকার কোন রবীন্দ্রনাথ!"
এই রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতায় রবীন্দ্রনাথের কিছু যায় আসে না। আকাশে উড়ন্ত ঈগল দেখে হাঁস-মুরগী শুধু ঈর্ষা করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। যে সময় তারা রবীন্দ্রনাথ পড়ত, সে সময় তারা নানা জিহাদি পাঠ্যপুস্তক পড়বে, জঙ্গি হবে। প্রথমে বিধর্মী মারবে। তারপর শিয়া-সুন্নি মারবে।
তারা রবীন্দ্রনাথ না পড়ে দেলোয়ার হোসেন সাঈদির 'নন্দিত জাতি নিন্দিত গন্তব্যে' পড়বে। কীভাবে মেয়েদের ছোট করা যায়, সেটা শিখবে। তারা শিখবে কীভাবে ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করা যায়। তারা শিখবে নারী মানেই শস্যখেত!
এই রবীন্দ্রনাথ-বিরোধিতা শুধু করেই যাবে তারা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ থাকবেন বাঙালির মননে। হুমায়ুন আজাদের উক্তিটিই ধ্রুবসত্য।
"রবীন্দ্রনাথ আজ বাঙলার মাটি থেকে নির্বাসিত তবে আকাশটা তাঁর। বাঙলার আকাশের নাম রবীন্দ্রাকাশ।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন