লিখেছেন ক্যাটম্যান
মুক্তচিন্তা চর্চা, প্রচার ও প্রসারের কারণে ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর নৃশংস হামলার শিকার হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় ও ফয়সল আরেফিন দীপন সহ নিহত ও আহত সকল মুক্তচিন্তকের স্মরণে এই লেখাটি অপরিমেয় ভালোবাসার স্মারক স্বরূপ নিবেদন করছি।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, পরোক্ষভাবে মূসার পরমেশ্বর পুনরায় স্বীয় নিরাপত্তা বিষয়ক ভীতি প্রকাশ করেছেন এখানে এবং মূসাকে এবারও প্রথমবারের ন্যায় কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। মূলত মূসা তার পরিকল্পিত পরমেশ্বরের অনুপস্থিতি আড়াল করতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বীয় ঈশ্বরের ভূমিকায় কঠোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার আদেশ জারি করেছেন। এতে করে ইস্রায়েলের জনগণ অতি গোপনীয়তা বজায় রাখার বিষয়টিকে যেন মূসার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড আড়াল করার অপপ্রয়াস বিবেচনা না করে ঐশ্বরিক আদেশ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচনা করেন।
দ্বিতীয়বার প্রস্তরফলক প্রদানের বিষয়ে বাইবেলের ‘দ্বিতীয় বিবরণে’ বলা হয়েছে:
সেসময় প্রভু আমাকে বললেন, তুমি প্রথমগুলোর মত দু’খানা প্রস্তরফলক কেটে আমার কাছে পর্বতে উঠে এসো, এবং কাঠের একটি মঞ্জুষা তৈরি কর। যে প্রথম প্রস্তরগুলো তুমি ভেঙে দিলে, সেগুলোতে যে যে বাণী লেখা ছিল, তা আমি এই দুই প্রস্তরফলকে লিখব, পরে তুমি তা সেই মঞ্জুষাতে রাখবে। [দ্বিতীয় বিবরণ ১০:১-২]
তবে এ বিষয়ে বাইবেলের বর্ণনায় একটি প্রকট স্ববিরোধিতা লক্ষণীয়। ওপরোক্ত শ্লোকসমূহে আমরা দেখতে পাই, মূসাকে পরমেশ্বর পুনরায় যে-দু'টি প্রস্তরফলক প্রদান করবেন, তা নিজ হাতে লিখে দেবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে যাত্রাপুস্তক ও দ্বিতীয় বিবরণের বর্ণনায় ভিন্নতা রয়েছে। দ্বিতীয় বিবরণে বর্ণনা করা হয়েছে:
তাই আমি বাবলা কাঠের একটি মঞ্জুষা তৈরি করলাম, এবং প্রথমগুলোর মত দু’খানা প্রস্তরফলক কেটে সেই দু’খানা প্রস্তরফলক হাতে করে পর্বতে উঠলাম। প্রভু জনসমাবেশের দিনে পর্বতে আগুনের মধ্য থেকে যে দশ বাণী তোমাদের জন্য জারি করেছিলেন, তিনি ওই দু’খানা প্রস্তরফলকে আগে যা লিখেছিলেন, তা লিখলেন। পরে তা আমাকে দিলেন। আমি মুখ ফিরিয়ে পর্বত থেকে নেমে সেই দু’খানা প্রস্তরফলক আমার তৈরি করা সেই মঞ্জুষাতে রাখলাম, আর সেসময় থেকে তা সেইখানে রয়েছে— যেমন প্রভু আমাকে আজ্ঞা দিলেন। [দ্বিতীয় বিবরণ ১০:৩-৫]
বাইবেলের উক্ত বর্ণনায় দেখা যায়, পরমেশ্বর নিজ হাতে লেখা দু'টি প্রস্তরফলক মূসাকে প্রদান করেছেন। কিন্তু যাত্রাপুস্তকের বর্ণনায় তা স্বীকার করা হয়নি। যাত্রাপুস্তকের বর্ণনানুযায়ী উক্ত প্রস্তরফলক দু'টি ছিল মূসার নিজ হাতে লেখা। এ বিষয়ে যাত্রাপুস্তকের বর্ণনা নিম্নরূপ:
প্রভু মোশীকে আরও বললেন, ‘তুমি এই সকল বাণী লিখে রাখ, কারণ আমি এই সকল বাণী অনুসারে তোমার ও ইস্রায়েলের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেছি।’ সেসময়ে মোশী চল্লিশদিন চল্লিশরাত সেখানে প্রভুর সঙ্গে থাকলেন - রুটি খেলেন না, জল পান করলেন না। তিনি সেই দু’টো প্রস্তরে সন্ধির বাণীগুলো অর্থাৎ দশ বাণী লিখে রাখলেন। যখন মোশী পর্বত থেকে নেমে এলেন - তিনি পর্বত থেকে নেমে আসার সময়ে তাঁর হাতে সেই দু’টো সাক্ষ্যপ্রস্তর ছিল - তখন প্রভুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন বিধায় তাঁর মুখের চামড়া যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন না। [যাত্রাপুস্তক ৩৪:২৭-২৯]
বস্তুত প্রস্তরফলক দু'টির উভয় সংস্করণই যে মূসার নিজ হাতে তৈরি করা ছিল, তা বুঝতে আমাদের বেশি বেগ পেতে হয় না। কারণ মূসা প্রথমবার যখন দুটি প্রস্তরফলক নিয়ে ইস্রায়েলের জনগণের মাঝে ফিরে এসেছিলেন, সেই ঘটনায় তাকে চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত পর্বতচূড়ায় অবস্থান করতে হয়েছিল। বাইবেলের বর্ণনানুযায়ী আমরা জেনেছি, ওই সময় প্রস্তরফলক দু'টি পরমেশ্বর নিজ হাতে লিখে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে:
যখন প্রভু সিনাই পর্বতে মোশীর সঙ্গে কথা বলা শেষ করলেন, তখন সাক্ষ্যের সেই দুই ফলক, পরমেশ্বরের আপন আঙুল দিয়ে লেখা সেই দুই প্রস্তরফলক, তাঁকে দিলেন। [যাত্রাপুস্তক ৩১:১৮]
পুনরায় এ বিষয়ে একই পুস্তকের পরের অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে:
তখন মোশী ফিরে পর্বত থেকে নেমে গেলেন, তাঁর হাতে ছিল সাক্ষ্যের সেই দুই প্রস্তরফলক; সেই ফলকের এপিঠে ওপিঠে, দু’পিঠেই লেখা ছিল। প্রস্তরফলক দু’টো পরমেশ্বরেরই নির্মাণকাজ, সেই লেখাও পরমেশ্বরেরই আপন লেখা - ফলকে খোদাই করে লেখা। [যাত্রাপুস্তক ৩২:১৫-১৬]
তবে পরমেশ্বরের নিজ হাতে লেখা প্রস্তরফলক দু’টির প্রথম সংস্করণ পেতে মূসাকে পর্বতচূড়ায় চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এখন দ্বিতীয়বারের মতো একই বিষয় সম্বলিত দুটি প্রস্তরফলক আনতে গিয়েও মূসাকে পর্বতচূড়ায় চল্লিশদিন চল্লিশরাত অবস্থান করতে হয়েছে। আর যাত্রাপুস্তকের বর্ণনানুযায়ী, প্রস্তরফলক দু'টির এই দ্বিতীয় সংস্করণ মূসার নিজ হাতে লেখা। পরমেশ্বরের নিজ হাতে লেখা দু'টি প্রস্তরফলকের প্রথম সংস্করণ আনতে গিয়ে পর্বতচূড়ায় মূসাকে যদি চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত অবস্থান করতে হয়, সেক্ষেত্রে একই বিষয় সম্বলিত দু'টি প্রস্তরফলকের দ্বিতীয় সংস্করণ মূসার নিজ হাতে লিখে আনতে চল্লিশ দিন চল্লিশ রাতের তুলনায় আরও অধিক সময় পর্বতচূড়ায় অবস্থান করাটা মূসার জন্য যুক্তিযুক্ত হত। কারণ প্রস্তরফলকে পরমেশ্বরের লিপিবদ্ধকরণ ক্ষমতা ও মূসার লিপিবদ্ধকরণ ক্ষমতা একই মানবিশিষ্ট হওয়ার কথা নয়। সামান্য হলেও তফাৎ থাকা সমীচীন ছিল। কিন্তু তা না হয়ে প্রস্তরফলক দু'টির উভয় সংস্করণ আনতে গিয়ে মূসার ব্যয় হয় চল্লিশ দিন চল্লিশ রাতের একই সময় পর্ব। আর সেই কারণে আমাদের সন্দেহ এই মর্মে যথেষ্ট যৌক্তিক ভিত্তি পায় যে, মূসার নিজ হাতে লিখে আনা প্রস্তরফলক দু'টির দ্বিতীয় সংস্করণের ন্যায় প্রস্তরফলক দু'টির প্রথম সংস্করণও মূসার নিজ হাতে লেখা ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন