আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বরাহেও আছেন, বিষ্ঠাতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি বোরখাতেও আছেন, বিকিনিতেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি জলাশয়েও আছেন, মলাশয়েও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি উটমূত্রেও আছেন, কামসূত্রেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি আরশেও আছেন, ঢেঁড়শেও আছেন # আল্যা সর্বব্যাপী – তিনি হাশরেও আছেন, বাসরেও আছেন

বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

উম হানি ও মুহাম্মদ: ইসলামের মহানবীর প্রথম ভালবাসা (পর্ব ৮)

লিখেছেন আবুল কাশেম


উম হানির ঘরে নবীর রাত্রি যাপন এবং মেরাজ

আগেই লেখা হয়েছে যে, নবীর ঈস্‌রা এবং মেরাজ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। বিগত দেড় হাজার বছর ধরে এই বিতর্ক চলছে এবং ভবিষ্যতেও যে চলবে, তাতে সন্দেহ নেই। কয়েকটি ব্যাপারে অনেক মতবিরোধ দেখা যায়। সেগুলি হল:
১. এই রাত্রিভ্রমণ (ঈসরা এবং মেরাজ) কখন হয়েছিল?
২. এই রাত্রিভ্রমণ কোথা হতে হয়েছিল?
৩. উম হানির সাথে নবীর এই রাত্রি সফরের কী সম্পর্ক?
প্রথম প্রশ্নের আংশিক উত্তর আগে দেওয়া হয়েছে। এখন একটু বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন।

মুহাম্মদের এই রাত্রিভ্রমণ যে মদিনায় হিজরতের আগেই হয়েছে, তাতে কোনো বিতর্ক নেই। অনেক নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে বোঝা যায় যে, এই আশ্চর্যজনক ঘটনা, খুব সম্ভবত, ৬১৯-৬২০ সালে হয়েছিল। আগেই জানানো হয়েছে যে, এই ঘটনার আগে নবী সওদাকে বিবাহ করেন। কিন্তু মুহাম্মদের জীবনী থেকে এটা পরিষ্কার হয় না যে, সওদাকে মুহাম্মদ কোথায় রাখতেন? সওদাকে যে তিনি কাবা ঘরে কিংবা তার কাছাকাছি কোথাও রাখতেন না, তা বোঝা যায়। খুব সম্ভবত, সওদা থাকতেন খদিজার গৃহে, কারণ সেখানেই ছিল মুহাম্মদের কন্যারা। সওদা তাদের দেখাশোনা করতেন এবং সাংসারিক অন্য কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর মুহাম্মদ বেশিরভাগ সময়ই কাটাতেন কাবা প্রাঙ্গণে—জিকির, নামায আর কোরান আবৃত্তি করে। কাবা প্রাঙ্গণেই মুহাম্মদ অনেক রাত্রি কাটাতেন। আমরা আগেই দেখেছি, কাবার যেখানে মুহাম্মদ কোরান পড়তেন, সে স্থান উম হানির ঘরের খুব সন্নিকটে ছিল—একেবারে পাশের বাড়ির মত। উম হানির সাথে রাত্রে মিলিত হবার এর চাইতে ভাল অবস্থা আর কী হতে পারে? তাই বিশ্বাস করা যায় যে, মুহাম্মদ অনেক সময়েই কাবা থেকে নিখোঁজ হয়ে যেতেন। অনেকেই এ নিয়ে হয়ত প্রশ্ন করত। তিনি হয়ত সদুত্তর দিতে পারতেন না। এভাবেই একবার তিনি সহসা রাত্রিকালে কাবা থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। লোকে তাঁর খোঁজ করতে তাকে। নিখোঁজের কারণ হিসেবে নবী ঈস্‌রা এবং মেরাজের উল্লেখ করেন। এর সমর্থনে কিছু হাদিস এবং ঘটনার বিবরণ দেওয়া হবে। পাঠকদের মনে রাখা দরকার যে, কাবার যে অংশে মুহাম্মদ কোরান পড়তেন এবং শুয়ে রাত্রি কাটাতেন সেই স্থানকে হিজর বলা হত। কাবার এই স্থানে কোরায়েশরা ব্যবস্থা করেছিল গরীব এবং পথিকদের বিশ্রাম অথবা নিদ্রার।

মার্টিন লিঙ্গস্‌-এর মতে, এই ঘটনা হয়েছিল উম হানির এবং আবু তালেবের অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের ইসলাম গ্রহণের পর—অর্থাৎ মুহাম্মদের মদিনায় হিজরত করার আগে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, উম হানির স্বামী হুবায়রা কক্ষনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাই এক পৌত্তলিক স্বামী নিয়ে কীভাবে উম হানি একই গৃহে বাস করেন, তাও চিন্তার বিষয়। উম হানি তা করে থাকলে তিনি নিশ্চয় ইসলামি আইন লঙ্ঘন করেছিলেন। যতটুকু ধারণা করা যায়, উম হানির স্বামী হুবায়রা গৃহে থাকতেন না। আমরা আগেই দেখেছি, উম হানির ইসলাম গ্রহণের সংবাদে হুবায়রা মনের দুঃখে কবিতা রচনা করেছিলেন এবং নির্বাসনে চলে যান।

দেখা যাক মার্টিন লিঙ্গস্‌ কী লিখেছেন ঈসরা এবং মেরাজ সম্পর্কে (পৃঃ ১০১):

একবার উনারা সবাই নবীর পিছনে নামাজ পড়লেন। এর পর উম হানি নবীকে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের সাথে রাত্রি যাপনের। মুহাম্মদ সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ ঘুমের পরই উঠলেন এবং মসজিদে চলে গেলেন। কেননা কাবায় রাত্রি কাটাতে নবী অতিশয় পছন্দ করতেন। সেখানে যাবার পর নবীর ঘুম আসতে থাকল; তিনি হিজরে ঘুমিয়ে পড়লেন।
তিনি বললেন, “আমি যখন যখন হিজরে ঘুমিয়ে ছিলাম তখন তখন জিব্রাঈল আমার কাছে আসলেন এবং তাঁর পা দিয়ে লাথি মারলেন। আমি সোজা হয়ে বসলাম। কিন্তু কিছুই দেখলাম না। তাই আবার শুয়ে পড়লাম। দ্বিতীয়বার জিব্রাঈল আসলেন। তারপর তৃতীয়বার। এইবার তিনি আমার হাত ধরলেন। আমি উঠলাম এবং জিব্রাঈলের পাশে দাঁড়ালাম। জিব্রাঈল আমাকে নিয়ে মসজিদের দরজার বাইরে এলেন। বাইরে একটা সাদা জানোয়ার দেখলাম। দেখতে গাধা এবং খচ্চরের মাঝামাঝি। জানোয়ারটির দুই পাশে ডানা ছিল। তার দ্বারা সে তার পা নাড়াচাড়া করছিল। তার প্রত্যেক পদক্ষেপ ছিল দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত।
এরপর মার্টিন লিঙ্গস্‌ বর্ণনা দিয়েছেন নবীর আকাশভ্রমণ, যার বিস্তারিত বিবরণ আমরা পরে দেখব। মজার ব্যাপার হল, রাত্রি শেষ হবার আগেই নবী আবার চলে যান উম হানির গৃহে। এবং তাঁকে বর্ণনা করেন রাত্রি ভ্রমণের কথা। এই থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, হিজর এবং উম হানির গৃহ ছিল খুবই নিকটবর্তী, যা আগেই বলা হয়েছে। তা না হলে মুহাম্মদের পক্ষে হুট করে, রাত থাকতে থাকতে আবার উম হানির গৃহে যাওয়া সম্ভব হত না।

দেখা যাক মার্টিন লিঙ্গস্‌ কী লিখেছেন (পৃঃ ১০৩):
যখন নবী এবং জিব্রাঈল জেরুজালেমের মসজিদে অবতরণ করলেন তখন মক্কায় ফিরে গেলেন যে পথ ধরে এসেছিলেন সেই পথ ধরে। ফিরার পথে অনেক দক্ষিণ-গামী কাফেলাকে অতিক্রম করলেন। যখন কাবায় ফিরে আসলেন তখনও গভীর রাত ছিল। কাবা থেকে নবী আবার গেলেন তাঁর চাচাত বোনের গৃহে। উম হানি নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন এই ভাবে: “ভোর হবার অল্পক্ষণ পূর্বেই নবী আমাদেরকে ঘুম হতে উঠালেন। এরপর আমরা ভোরের (ফজরের) নামায শেষ করলাম। তিনি বললেন: ‘ওগো উম হানি! তুমি ত জানই, আমি তোমার সাথে এই উপত্যকাতেই গতকালের সন্ধ্যা নামায পড়েছিলাম। এর পর আমি জেরুজালেমে যাই। সেখানেও নামায পড়লাম। এখন ত তুমি দেখছ, আমি তোমার সাথে ভোরের নামায পড়লাম।‘ নবী উঠলেন চলে যাবার জন্য। আমি তাঁর পরনের ধুতি ধরে এত জোরে টানাটানি করলাম যাতে ধুতি আলগা হয়ে পড়ে গেল। এর ফলে আমি তাঁর পেট দেখে ফেললাম। তাঁর পেট মনে হচ্ছিল যেন তুলা দিয়ে ঢাকা। আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর নবী। এই কথা লোকজনকে জানাবেন না। কেননা তারা আপনাকে মিথ্যুক বলবে আর অপমান করবে।’ নবী বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তাদেরকে বলব।’
এখন ইবনে সা’দের লেখা আল তাবাকাত আল কবির থেকে কিছু জানা যাক।

ইবনে সা’দ লিখেছেন ঈস্‌রা এবং মেরাজ উম হানির গৃহ থেকেই হয়েছিল (খণ্ড ১, পৃঃ ২৪৮):
রাত্রে শোবার আগে উনি উম হানির সাথে এশার (সন্ধ্যা) নামায পড়েন। কোন কোন বর্ণনাকারী বলেছেন: ঐ রাত্রে নবী (স.) নিখোঁজ হয়ে যান। তাই আবদুল মুত্তালিবের পরিবারের সদস্যরা নবীর খোঁজে বাহির হন। আল আব্বাস জু তুয়াসে গিয়ে চিৎকার করলেন: ওহে মুহাম্মদ! ওহে মুহাম্মদ! আল্লাহর রসূল (স.) জবাব দিলেন: আমি যে এখানে। আল আব্বাস বললেন: হে আমার ভায়ের পুত্র! রাত্রির শুরুর থেকেই আপনি আমাদেরকে উদবিঘ্ন করে তুলেছেন। আপনি কোথায় ছিলেন? নবী উত্তর দিলেন: আমি বায়তুল মোকাদ্দিস থেকে আসছি। আল আব্বাস বললেন: এক রাত্রিতেই? নবী উত্তর দিলেন: হাঁ, তাই। আল আব্বাস জিজ্ঞাসা করলেন: ‘আপনি কি ভাল ছাড়া খারাপ কিছু অভিজ্ঞতা পেয়েছেন?’ নবী উত্তর দিলেন: আমার সব অভিজ্ঞতাই ভাল। উম হানি বললেন: নবীর রাত্রিভ্রমণ আমার গৃহ থেকেই হয়েছে। ঐ রাতে নবী আমাদের গৃহে ঘুমান। এশার নামায শেষ করে উনি ঘুমাতে যান। অতি প্রত্যুষে আমরা উনাকে ভোরের নামাযের (ফজরের) জন্য জাগালাম। তিনি বললেন: ওহে উম হানি! তুমি ত সাক্ষী, আমি তোমার সাথে এশার নামায পড়েছি। এর পর আমি বায়তুল মোকাদ্দিস গেলাম এবং সেখানে নামায পড়লাম। এরপর আমি ফজরের নামায পড়লাম তোমার সামনেই। এরপর নবী চলে যাবার উদ্যোগ করলেন। আমি বললাম: এই ঘটনা কাউকে বলবেন না। কারণ তারা আপনাকে মিথ্যুক বলবে এবং আপনার ক্ষতি করবে। তিনি বললেন; আল্লাহর কসম, আমি এই ঘটনা সবাইকে জানাব। লোকেরা যখন জানল তখন বলল: আমরা কস্মিনকালেও এই ধরণের কাহিনী শুনি নাই। আল্লার রসূল (স.) জিব্রাঈলকে বললেন: ওহে জিব্রাঈল! ওহে জিব্রাঈল! ওহে জিব্রাঈল! আমার লোকজন বিশ্বাস করবে না। আবু বকরই এর সত্যতা স্বীকার করবে। কারণ আবু বকর হচ্ছেন আল সিদ্দিক। বর্ণনাকারী জানালেন: অনেক ব্যক্তিই যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং নামায পড়েছিল—তারা ইসলাম ছেড়ে দিল। নবী বলতে লাগলেন: আমি হিজরে দাঁড়িয়েছিলাম। বায়তুল মোকাদ্দিস আমি চাক্ষুষ দেখছিলাম এবং এর বর্ণনা দিচ্ছিলাম। কেউ কেউ জিজ্ঞাস করল: ঐ মসজিদের কয়টা দরজা? আমি ত তা গণনা করি নাই। তাই কল্পনায় আমি মসজিদের প্রতি লক্ষ্য করলাম এবং এক এক করে দরজার সংখ্যা গণনা করলাম। তারপর এই তথ্য জানালাম। আমি যে সব কাফেলা দেখছিলাম সেগুলোরও বিবরণ জানালাম। লোকেরা দেখল ঐ কাফেলা হুবহু আমি যা বলেছি সেই রকম। এর পরেই আল্লাহ-পাক পাঠিয়ে দিলেন তাঁর বাণী: আমরা আপনাকে সেই দৃষ্টি দিলাম যেই দৃষ্টি দ্বারা আমরা আপনাকে দেখিয়েছি মানব জাতির অগ্নিপরীক্ষা। উনি (ইবনে সা’দ) বললেন এর মানে হল: নবী যা চাক্ষুষ দেখেছেন তারই বর্ণনা।
এখন আমরা ইবনে ইসহাকের বর্ণনা দেখব (পৃঃ ১৮৪):
উম হানি বিন্‌ত আবু তালেব, যাঁর আসল নাম হচ্ছে হিন্দ, তাঁর থেকে রসূলের রাত্রি ভ্রমণ সম্পর্কে আমি এই বর্ণনা শুনেছি:
তিনি (উম হানি) বললেন: আল্লাহর রসূলের রাত্রি ভ্রমণ আমার গৃহ ছাড়া অন্য কোথা হতে হয় নাই। ঐ রাত্রে উনি আমার গৃহে ঘুমান। রাতের সর্বশেষ নামাজ শেষ করে উনি ঘুমাতে যান; সেই সাথে আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরের কিছু আগেই উনি আমাদেরকে জাগিয়ে তুললেন। আমরা ফজরের নামাজ পড়লাম। তারপর উনি বললেন: “তুমি ত জানই তোমার সাথে এই স্থানেই (উপত্যকায়) আমি সান্ধ্য নামায পড়েছিলাম। তারপর আমি জেরুজালেমে যাই এবং সেখানেও নামায পড়ি। তারপরই তুমি ত দেখলে আমি তোমার সাথে এই ফজরের নামায পড়লাম।" এই বলে নবী চলে যেতে চাইলেন। আমি উনার আলখাল্লা ধরে টান দিলে তা খুলে পড়ে গেল। আমি নবীর উলঙ্গ পেট দেখতে পেলাম। তাঁর সেই পেট দেখতে ছিল ভাঁজ করা মিসরীয় তুলার তৈরি পোশাক। আমি বললাম: “হে আল্লাহর নবী, আপনি এই সংবাদ কাউকে জানাবেন না। কারণ এই সংবাদ জানলে তারা আপনাকে মিথ্যুক বলবে এবং অপমান করবে।” তিনি বললেন: “আল্লাহর কসম, আমি তাদেরকে জানাবই”। আমার নিগ্রো ক্রীতদাসীকে নির্দেশ দিলাম: “তুমি নবীকে অনুসরণ কর আর শ্রবণ কর উনি কি বলেন, আর তারা কি বলে।” সত্যি-সত্যি নবী উপস্থিত লোকদের ঘটনার বিবরণ দিলেন। এই শুনে তারা আশ্চর্য্যাম্বিত হয়ে গেল। তারা তাঁর দাবীর প্রমাণ চাইল। নবী বললেন তিনি অমুক অমুক কাফেলা দেখেছেন অমুক অমুক স্থানে। এই কাফেলাগুলো তাঁর বাহন দেখে ভীত হয়ে গেল। এমনকি একটা উট দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি তাদেরকে জানালাম কোথায় এই ঘটনা ঘটল। আমি বললাম যে ঐ সময় আমি সিরিয়ার পথে ছিলাম। এর পর আমি দাজানান পর্যন্ত গেলাম। সেখানে আমি অমুক গোত্রের কাফেলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম লোকজন নিদ্রিত। তাদের সাথে বয়মে ভরা পানি ছিল। বয়মের মুখ কিছু ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা ছিল। আমি ঢাকনা খুলে পানি পান করলাম। তারপর ঢাকনা লাগিয়া দিলাম। এর প্রমাণ এই যে এই মুহূর্তে ঐ কাফেলাটি তানিমের গিরিপথ দিয়ে বায়দা থেকে আসছে। কাফেলাটির অগ্রে রয়েছে কালচে রঙ্গের এক উট যার পিঠে রয়েছে দুটি বস্তা—একটি কালো আরেকটি নানাবর্ণের।” লোকজন হুড়হুড় করে গিরিপথের মুখে চলে গেল ঐ কাফেলার আগমন দেখতে। প্রথম যে উটটি তারা দেখল তা হুবহু আমি যে রূপ বলেছিলাম সেই রূপ ছিল। তারা কাফেলার লোকদেরকে ঐ বয়েমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করল। তারা উত্তর দিল যে বয়েমটা তারা পানি ভর্তি করে তার মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। তারা ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করল যে বয়েমের মুখ বন্ধই ছিল কিন্তু বয়েমের ভিতর ছিল শূন্য। মক্কার অন্যান্য লোকেরাও তাদের সাথে সায় দিল। এ জেনে কাফেলার লোকেরা ভীত হয়ে পড়ল এবং সে সাথে তাদের এক উটও পালিয়ে গেল। এরপর তাদের একজন উটকে ডাকতে থাকল। পরে সে উটটি ফিরে পেল।
আশ শিফা গ্রন্থে মেরাজ ঘটনা এইভাবে লিখিত হয়েছে (আশ শিফা, পৃঃ ৯৮):
উম হানি বর্ণনা করলেন: “যে রাতে আল্লাহর রসূল রাত্রি ভ্রমণে যান সেই রাত্রে উনি আমার গৃহে ছিলেন। উনি আমাদের সাথে রাত্রির শেষ নামায পড়লেন এবং আমাদের সাথে ঘুমিয়ে গেলেন। ফজরের নামাযের সময় উনি আমাদেরকে জাগিয়ে দিলেন। তারপর আমাদের সাথে ফজরের নামায পড়লেন। উনি বললেন: ‘উম হানি, আমি গতরাত্রের শেষ নামায তোমার সাথে পড়েছিলাম, যা তুমি জান। তারপর আমি জেরুজালেমে গিয়ে নামায পড়েছি। আর এখন তুমি দেখছ আমি তোমার সাথে ভোরের নামায পড়েছি।’”
মুহাম্মদের মিসরীয় জীবনীকার হুসায়েন হাইকল লিখেছেন:
ঈস্‌রার রাত্রে মুহাম্মদ তাঁর চাচাত বোন হিন্দ বিন্‌ত আবু তালেবের গৃহে ছিলেন। হিন্দকে উম হানি বলেও ডাকা হত। হিন্দ বর্ণনা করলেন: ‘‘আল্লাহর রসূল আমার ঘরে রাত্রি কাটালেন। রাত্রের নামায শেষ করে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ভোরের অল্পকিছু পূর্বে উনি আমাদেরকে জাগিয়ে দিলেন এবং আমরা সবাই একত্রে ভোরের নামায পড়লাম। নামায শেষ হলে নবী বললেন: ‘উম হানি আমি এই স্থানে তোমার সাথে রাত্রির নামায পড়েছি। তারপর আমি জেরুজালেমে গেলাম এবং সেখানে নামায পড়লাম। আর এখন ত দেখলেই আমি তোমার সাথে ভোরের নামায পড়লাম।’ আমি উত্তর দিলাম, ‘হে আল্লাহর রসূল, আপনি কাউকে এই সংবাদ দিবেন না, কেননা তারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে এবং আপনার ক্ষতি করবে।’ উনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি সবাইকে জানাব।’’’
স্যার উইলিয়াম মুরের মতে মুহাম্মদের রাত্রি ভ্রমণ হয়েছিল খুব সম্ভবত ৬২১-৬২২ সালের কোন এক সময়। অর্থাৎ মদিনায় হিজরতের বছর খানেক আগে। এবং এই সফর হয়েছিল আবু তালেবের গৃহ হতে। এখানে আবু তালেবের গৃহ বলতে কী বোঝান হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। খুব সম্ভবত, উম হানির গৃহ এবং আবু তালেবের গৃহ একই ছিল—কাবার একেবারেই কাছাকাছি।
পরের দিন ভোর বেলায় আবু তালেবের গৃহে যখন উনি (মুহাম্মদ) ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন তখনও উনার তন্দ্রায় সে রাতের স্বপ্নের রেশ লেগে ছিল বেশ পরিষ্কার ভাবে—যেন বাস্তবের মত। তিনি চিৎকার করে আবু তালেবের কন্যাকে বলে উঠলেন যে রাত্রি বেলায় তিনি জেরুজালেমের মসজিদে প্রার্থনা করেছেন। তারপর বললেন যে এই ঘটনা তিনি সবাইকে জানাবেন। সে সময় আবু তালেবের কন্যা উনার পোশাক ধরে মিনতি করলেন এই ব্যাপার কাউকে না জানানোর জন্য। কিন্তু নবী নিজের কথায় অটল থাকলেন। (উইলিয়াম মুর, পৃঃ ১২১)
নীচে খাসায়েসুল কুবরা থেকে মেরাজ এবং উম হানি সংক্রান্ত কিছু হাদিস দেওয়া হল (খণ্ড ১, পৃঃ ৩৩৪ ৩৩৮):
হযরত উম্মে হানির (রাঃ) হাদিস
ইবনে ইসহাক ও ইবনে জরীর আবূ ছালেহ এর বরাত দিয়ে রেওয়ায়েত করেছেন যে, উম্মে হানি বিনতে আবূ তালেব (রাঃ) বর্ণনা করেন, শবে মে’রাজে নবী করীম (সাঃ) আমার গৃহে নিদ্রিত ছিলেন। এর আগে তিনি এশার নামায পড়েন। এরপর তিনিও ঘুমিয়ে পড়েন এবং আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরের আগে তিনি আমাদেরকে জাগ্রত করলেন। তাঁর সাথে আমরাও যখন ভোরের নামায পড়ে নিলাম, তখন তিনি বললেন: উম্মেহানি! আমি তোমাদের সাথে এখানে এশার নামায পড়েছিলাম, যা তুমি নিজে দেখেছ এরপর আমি বায়তূল মোকাদ্দাসে চলে যাই। আমি সেখানে নামায পড়েছি। এখন আবার তোমাদের সাথে ফজরের নামায পড়লাম, যা তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছ।
তিবরানী, ইবনে মরদুওয়াইহি হযরত উম্মে হানি (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, শবে মে’রাজে নবী করীম (সাঃ) আমার গৃহে নিদ্রিত ছিলেন। আমি রাতে তাঁকে পেলাম না। ফলে এ আশংকায় সারারাত আমার ঘুম হল না যে, কোথাও কোরায়শরা তাঁকে অপহরণ করেনি তো?
এরপর হুযুর (সাঃ) বললেন: জিবরাঈল আমার কাছে এলেন এবং আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। আমি দরজার বাইরে একটি চতুষ্পদ জন্তু দেখলাম, যা খচ্চর অপেক্ষা নিচু ও গাধা অপেক্ষা উঁচু ছিল। জিবরাঈল আমাকে তাঁর উপর সওয়ার করিয়ে বায়তুল মকাদ্দাস নিয়ে গেলেন। আমাকে হযরত ইবরাহীম (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করালেন। তাঁর দৈহিক গড়ন আমার গড়নের অনুরূপ ছিল। জিবরাঈল মূসা (আঃ) এর সাথে দেখা করালেন। তিনি গোধুম বর্ণের, লম্বা গড়নের এবং সোজা চুলওয়ালা ছিলেন। শানওয়া গোত্রের পুরুষদের সাথে তার বহুলাংশে মিল ছিল। হযরত ঈসা (আঃ) এর সাথেও সাক্ষাৎ হয়। তিনি মাঝারি গড়নের সাদা চুলওয়ালা ছিলেন। তাঁর রঙে লালিমার ঝলক ছিল। ওরওয়া ইবনে মসউদ ছকফীর সাথে তাঁর মিল ছিল। আমাকে দাজ্জালও দেখানো হয়। তার ডান চক্ষু নিশ্চিহ্ন ছিল। সে কুতুন ইবনে আবদুল ওযযার অনুরূপ ছিল।
উম্মে হানি বর্ণনা করেন—অতঃপর হুযুর (সাঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন: আমি মে’রাজের ঘটনা বলার জন্যে কোরায়শদের কাছে যেতে চাই। উম্মে হানি বলেন; আমি হুযুর (সাঃ) এর কাপড় ধরে ফেললাম এবং বললাম; আল্লাহর কসম, যারা আপনাকে মিথ্যারোপ করে এবং আপনার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করে, আপনি তাদের কাছে যাবেন না। তারা আপনার বাড়াবাড়ি করবে। কিন্তু তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না এবং আমার হাত থেকে কাপড় ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন। কয়েকজন কোরায়েশ নেতা এক জায়গায় সমবেত ছিল। হুযুর (সাঃ) সেখানে যেয়ে মে’রাজের ঘটনা বর্ণনা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুতয়িম ইবনে আদী দাঁড়িয়ে গেল এবং বলল: মোহাম্মদ! যদি তুমি সুস্থ চিন্তা ভাবনার অধিকারী হতে, তবে এমন আজগুবী কথা বলতে না। এরপর উপস্থিত লোকদের একজন বলল: মোহাম্মদ! আপনি অমুক অমুক জায়গায় আমাদের উটদের কাছে গিয়েছিলেন?
আবূ ইয়ালা ও ইবনে আসাকির রেওয়ায়েতে হযরত উম্মে হানি (রাঃ) বলেন: নবী করীম (সাঃ) ভোর বেলায় আমার কাছে আগমন করলেন। আমি তখন শয্যায় ছিলাম। তিনি বললেন: তুমি তো জান আমি আজ রাতে মসজিদে হারামে নিদ্রিত ছিলাম। জিবরাইল আমার কাছে এসে আমাকে মসজিদের দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। আমি একটা সাদা চতুষ্পদ জন্তু দেখলাম, যা গাধার চেয়ে উঁচু এবং খচ্চরের চেয়ে নীচু ছিল।
তার উভয় কান স্থির ছিল না—কেবলি আন্দোলিত হচ্ছিল। আমি তাতে সওয়ার হলাম। জিবরাঈল আমার সঙ্গে ছিলেন। জন্তুটি আপন পা দৃষ্টির শেষ সীমায় রেখে রেখে চলতে লাগল। যখন সে নিম্নভূমিতে চলত, তখন তার হাত লম্বা এবং পা খাটো হয়ে যেত, আর যখন উঁচু জায়গায় আরোহণ করত, তখন পা লম্বা ও হাত খাটো হয়ে যেত।
আমরা বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছলাম। আমি জন্তুটি সেই বৃত্তের সাথে বেঁধে দিলাম, যেখানে পয়গাম্বারগণ আপন আপন সওয়ারী বাঁধতেন। পয়গাম্বারগণকে আমার সামনে প্রকাশ করা হল। তাঁদের মধ্যে হযরত ইবরাহীম, মূসা, ও ঈসা (আঃ) ছিলেন। আমি তাঁদেরকে নামায পড়ালাম এবং তাঁদের সাথে কথাবার্তা বললাম। এরপর আমার সামনে লাল ও সাদা দুটি পাত্র আনা হল। আমি সাদা পাত্রটি পান করলাম। জিবরাঈল বললেন: আপনি দুধ পান করেছেন এবং শরাব প্রত্যাখান করেছেন। শরাব পান করলে আপনার উম্মত মুরতাদ হয়ে যেত। এরপর আমি সওয়ারীতে সওয়ার হয়ে মসজিদে হারামে এলে ফজরের নামায পড়েছি।
উম্মে হানি বর্ণনা করেন—একথা শুনে আমি হুযুর (সাঃ) এর চাদর ধরে ফেললাম এবং বললাম: ভাই। আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি, যদি আপনি কোরায়শদের সামনে একথা প্রকাশ করেন, তবে যারা এখন ঈমানদার, তারাও বেঈমান হয়ে যাবে। হুযুর (সাঃ) চাদরের উপর হাত মেরে সেটি আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। চাদর তার পেট থেকে সরে গেল। আমি তার লুঙ্গির উপর পেটের ভাজকে জড়ানো কাগজের ন্যায় দেখতে পেলাম। আমি আরও দেখলাম, তাঁর হৃদপিণ্ডের জায়গা থেকে নূর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এবং আমার দৃষ্টি ছিনিয়ে নেয়ার উপক্রম হচ্ছিল। আমি অভিভূত হয়ে সিজদায় পড়ে গেলাম। যখন মাথা তুললাম তখন দেখি হুযুর (সাঃ) চলে গেছেন। আমি কাল বিলম্ব না করে বাঁদীকে বললাম: জলদি তাঁর পিছনে পিছনে যা। তিনি কি বলেন এবং শ্রোতারা কি জওয়াব দেয়, তা শুনে তাড়াতাড়ি আমার কাছে আয়।
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন